শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

তখনো সাগর দেখিনি আমি

সমরেশ মজুমদার

তখনো সাগর দেখিনি আমি

জন্মেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক বসন্তের দুপুরে। উত্তর বাংলার এক পাহাড়ি চা বাগান গয়েরকাটায়। তখন বাড়িতেই শিশু জন্মাত। বোধহয় সেই কারণেই শিশুমৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। শুনেছি, ভরদুপুরে, মানে যখন ভূতে মারে ঢেলা তখন আমি পৃথিবী দেখে ভড়কে কেঁদে উঠেছিলাম। কিংবা নিজের ভূত দেখেও কান্না আসতে পারে, নইলে তখনই মায়ের প্রবল জ্বর আসবে কেন? জন্মমাত্র আমি অন্যের কৃপায় বেঁচেছি। মাতৃদুগ্ধ শুধু গর্ভধারিণীই দেন না, অন্য কোনো সদ্য মা সেই কর্তব্য করে জননী হয়ে উঠতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা নিয়েছিলেন সেজোপিসিমা। ওঁর মেয়ে শোভা তখন সবে জন্মেছিল। আবার অদ্ভুত ব্যাপার, যিনি আমার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, তিনি আমার স্মৃতিতে থেকে গেছেন ভয়ঙ্কর স্মৃতি হয়ে। চার বছর বয়সে চা-বাগানের কোয়ার্টার থেকে হিন্দুপাড়ায় ছুটেছিলাম বড়দের পিছু পিছু। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সেজোপিসিমা খাটে শুয়ে আছেন, তার দুই-পা আমার দিকে। সাদা হয়ে যাওয়া সেই পা-দুটির নিচে সিঁদুর বোলাচ্ছিল কেউ। কাঁদছিল সবাই। সাদা পায়ে লাল সিঁদুরের ছবি আজও ভুলতে পারিনি। আমাকে যিনি রক্ষা করেছিলেন, তিনিই প্রথমবার মৃত্যুর স্মৃতি এঁকে দিয়ে গেলেন। অথচ মৃত্যু কী তা তখন বুঝিনি। শৈশবে শোক বড় শিথিল হয়ে থাকে। গয়েরকাটায় যে কোয়ার্টার্সে জন্মেছি সেখানে এখন বুবু-জয়দীপ থাকে। তখন কোয়ার্টারের সামনে খেলার মাঠ ছিল। আর মাঝখানে একটা লম্বা স্বর্ণচাঁপার গাছ। ওপাশে অসম রোড। দিনেরাতে হাতেগোনা গাড়ি চলত, তাই দিনভর ঘুঘুরা ডেকে যেত। তিন-চার বছর বয়সে ভাবতে চাইতাম ওরা কেন এত ডাকে? কোয়ার্টারের পেছনে সজনে আর কুলগাছের ঝোপ, তারপর আমার প্রিয় নদী আংরাভাসা। আমার সাম্রাজ্য। যা প্রিয় তার কথা বারবার মনে আসে। আমার লেখায় তাই আংরাভাসা এসেছে বারবার। মজার কথা, যে আংরাভাসাকে দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছিলাম, সে মূল নদী নয়, শাখা নদী। গয়েরকাটার বাজারকে পাশে রেখে খাল কেটে নদীর জল নিয়ে আসা হয়েছিল চা বাগানের বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য। চওড়ায় বড়জোর পঁচিশ ফুট, হাঁটুর উপর তার জল উঠত না কিন্তু স্রোত ছিল তীব্র। পরিষ্কার সেই জল ছটফটিয়ে বয়ে যেত বিদ্যুৎ তৈরি করতে। সেই বালককাল থেকে এই নদীর পাশে বসে কত রঙিন মাছের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল চিংড়িকে মুঠোয় ধরে তার পায়ের সংখ্যা গুনতে চেষ্টা করেছি। অথচ আমাদের কোয়ার্টার্স থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে বয়ে যাওয়া আংরাভাসার মূল স্রোতকে দেখতে যাওয়ার কৌতূহল হয়নি। ওই ছোট্ট আংরাভাসায় চা বাগানের কামিনরা স্নান করতে আসত। পাড়ের কুলগাছ, কলাগাছ, পাথর বা ছাগলছানার মতোন বালক আমাকেও ওরা প্রকৃতির একটা অঙ্গ হিসেবেই ভাবত। বিবস্ত্র হতে বিব্রত হতো না। অথচ আমি দৌড়তাম মুখ ফিরিয়ে নদীর ধার দিয়ে। ওই বয়সে মনের ভিতর যে মন আছে, সে বলত দেখা উচিত নয়। তার চেয়ে নদীর হাঁটুজলে লাল চিংড়ি বা দাঁড় উঁচিয়ে আসা রাগী কাঁকড়াদের দেখো অথবা ওই ঢেউগুলো, যে ঢেউ গিয়ে মিশেছে ডুডুয়ায়, ডুডুয়া থেকে জলঢাকায়। তারপর অনেক নদীর সঙ্গে গলাগলি করে সাগরে। ওই সাগর শব্দটি সদ্য শেখা। তখনো আমি সাগর দেখিনি। হঠাৎ একদিন কানে এলো, ওদের একজন বলছে, ‘ওই দ্যাখ, একটা ছেলে উপরে দাঁড়িয়ে আছে।’ ‘নতুন আসা সেই কিশোরীকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল দলের বয়স্করা। বলেছিল, ‘ধেৎ, ও তো এখনো বাচ্চা।’ দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। অনেকটা দূরে এসেও কথাটা মন থেকে মুছতে পারিনি। আমি এখনো বাচ্চা। বড় হয়ে গেলে ওখানে আর দাঁড়াতে পারব না। কী জানি, হয়তো সেই মুহূর্ত থেকে আমার বড় হওয়া শুরু হয়ে গেল। লেখক : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর