শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কর্মকর্তারা

ভাসানচরে অস্থায়ী রোহিঙ্গা আবাসন

নিজামুল হক বিপুল

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার নোয়াখালীর ভাসানচর নামক দুর্গম স্থানে আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করেছে। গতকালই ওই চর এলাকা ঘুরে এসেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই বিভাগের দুই সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওই চরে রোহিঙ্গাদের আবাসন গড়া হলে কোনোরকম সমস্যা হবে কি না, চর এলাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি কেমন, চরটি বসবাসের যোগ্য কি না— এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তারা এ ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেবে। এর পরই আবাসন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে এই পদক্ষেপ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার একেবারে দুর্গম এলাকা ভাসানচরে অস্থায়ী আবাসন গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চরটির অবস্থান নোয়াখালী সদর থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরে। দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে নদীপথে যেতে হয় এই চরে। দ্বীপটির আয়তন লম্বায় ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ৩ কিলোমিটার। বিশাল এই দ্বীপে কয়েক লাখ লোকের আবাসন গড়ার সুযোগ রয়েছে। এ চিন্তা থেকেই সেখানে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে সরকার।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই দশক আগে মেঘনার বুকে এ চরটি জেগে উঠেছিল। প্রথম দিকে এটি জাইল্লার চর (জেলের চর) নামে পরিচিত ছিল। এরপর নাম পরিবর্তন হয়ে কাঁকড়ার চর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সর্বশেষ এটি ঠেঙ্গারচর, যা বর্তমানে ভাসানচর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশাল আয়তনের এই চরে সরকারিভাবে বনায়ন শুরু হয় ২০১০-১১ সালে। হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও ঢালচরের জেলেরা এই চরের আশপাশে নদীতে মাছ শিকার করেন এবং চরে এসে বিশ্রাম নেন। দুর্গম এই চরে বন ও জলদস্যুদের দাপট ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নৌবাহিনীর অবস্থানের পর থেকে দস্যুদের তৎপরতা খুব একটা নেই। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা ও উপজেলা শহর থেকে ভাসানচরের অবস্থান অনেক দূরে এবং যাতায়াতব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় সেখানে কোনো বসতি গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি নিয়মিত প্রবেশ করে এই চরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী আবাসন গড়ে তুলতে চলতি বছরের শুরুতে উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই সময় বাংলাদেশে অবস্থান করা প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গাকে হাতিয়ার ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগে থেকে অবস্থান করা এই ৪ লাখ রোহিঙ্গার আবাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ২৪ আগস্ট থেকে আবারও নতুন রোহিঙ্গার ঢল নামে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এ অবস্থায় গত এক মাসে নতুন করে আরও প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তারা ক্রমেই কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের ভাসানচরে আবাসন গড়ার ব্যাপারে প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন আহমেদ, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়াল অ্যাডমিরাল এ এম এম এম আওরঙ্গজেব চৌধুরী, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী গতকাল ভাসানচরে সরেজমিন ঘুরে এসেছেন। সেখান থেকে ফিরে গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাসানচর আমরা সরেজমিন দেখে এসেছি। সেখানে আবাসন গড়ে তোলা যায় কি না এটিসহ সামগ্রিক বিষয় খতিয়ে দেখতে নেভিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সবকিছু যাচাই-বাছাই করে শিগগিরই একটি প্রতিবেদন দেবে। এর পরই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, সেটি নেভিই বাস্তবায়ন করবে।’ তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। এর আগে গত বছর অক্টোবরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা এবং আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য ভাসানচরকে প্রাথমিকভাব বাছাই করে আন্তর্জাতিক সমর্থন চায় সরকার। ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের জানানো হয়েছিল, এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও পাশের জেলাগুলোতে নানা সংকট সৃষ্টি করছে। তখন বিদেশি কূটনীতিকরা এ ব্যাপারে সরকারের পরিপূর্ণ পরিকল্পনা জানতে চেয়েছিলেন। সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে ভাসানচর নিয়ে সরকার বিভিন্ন কাজ করেছে। আর গত এক মাসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করায় পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গার আগমনের ফলে কক্সবাজার এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তাই সরকার এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ভাসানচরে স্থানান্তরের পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ভাসানচরে নেভিকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন গড়ে তোলা হলে সেটি বাসযোগ্য করে তোলা হবে। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে।

সর্বশেষ খবর