বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের একটি পাহাড়ি গ্রামের নাম তুমব্রু। সেখানে একটি পাহাড়ের চূড়ায় ২৫ একর জমিতে চলছে বাণিজ্যিকভিত্তিক কুমির চাষ। প্রকল্পটি বেশ বড়। তবে উদ্যোক্তারা ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেছেন। তাদের স্বপ্ন কুমির রপ্তানি করে ভবিষ্যতে বছরে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন। এখানে ২০০৮ সালে ৫০টি কুমির নিয়ে যাত্রা হয় কুমির চাষ প্রকল্পের। ধীরে ধীরে ওই হ্যাচারিতে কয়েকটি শেডে ছোট-বড়-মাঝারি মিলে এখন সহস্রাধিক কুমির রয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে ইটের দেয়ালের সঙ্গে নেটবেষ্টিত একটি খাঁচা রয়েছে। ভিতরে আছে বয়সানুক্রমিক কুমিরের কয়েকটি শেড। এক পাশে ছোট, মাঝখানে মাঝারি এবং আরেক পাশে রয়েছে বড় কুমিরের ডোবা। কুমিরের বাচ্চাগুলোকে দেখা যায় পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে কলা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। আবার মাঝারি ও বড় কুমিরগুলোকে দেখা যায় তপ্ত রোদে পানিতেই চোখ বুজে রয়েছে। তবে কেউ উঁকিঝুঁকি দিলে সজাগ হয়ে যায় বড় কুমিরগুলো। প্রকল্পের উদ্যোক্তারা জানান, ২৫টি পুরুষ আর ২৫টি স্ত্রী কুমির দিয়েই শুরু হয় প্রকল্পটি। কয়েক মাস পর ৫টি পুরুষ কুমির মারা যায়। প্রথম তিন বছর মা কুমিরগুলো ডিম ছাড়লেও কোনো বাচ্চা হয়নি। তবে ২০১২ সালে বাচ্চা আসতে শুরু করে। ওই বছর ১৬০টি বাচ্চা দিলেও ২০১৩-১৪ সালে কোনো বাচ্চা আসেনি। এরপর আবার ২০১৫ সালে ২০০ বাচ্চা আসে। একইভাবে ২০১৬ সালে ২২০ ও চলতি বছরে বাচ্চা এসেছে চার শতাধিক। সব মিলিয়ে এখন কুমিরের সংখ্যা সহস্রাধিক। জানা যায়, প্রতিটি কুমিরছানা দৈনিক ১০০ গ্রাম করে খাবার খায়। তাদের গরু ও মুরগির মাংসের কিমা বানিয়ে খাওয়াতে হয়। আবার এক বছর বয়সী কুমিরছানাকে ২৫০ গ্রাম খাবার দিতে হয় এক দিন অন্তর। তাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ ও মাংস। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে অন্তত ৫০০ কুমিরের চামড়ার একটি চালান জাপানে রপ্তানি করার প্রস্তুতি চলছে। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে প্রতি অর্থবছরে ১ হাজার চামড়া রপ্তানির চিন্তা রয়েছে। থাইল্যান্ড, জাপান, জার্মানি ও চীন কুমিরের চামড়ার পাশাপাশি কুমিরের মাংস নিতেও আগ্রহী। এতে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ থেকে বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলেও জানান তিনি। তবে এখনো অধিকাংশ কুমিরই রপ্তানিযোগ্য হয়নি। জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের ১টি কুমিরের ন্যূনতম মূল্য ২৫০০ থেকে ৩৫০০ ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৫০০ কুমিরের চামড়ার মূল্য ৮ কোটি ২০ লাখ কোটি টাকা। এ সংখ্যা যদি ১ হাজারে ওঠে তাতে বছরে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। প্রকল্পের বড় অংশই খালি রয়েছে। এর বিস্তৃতি ঘটিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা কুমিরের চামড়া ও মাংস থেকে আয় করা যাবে বলে আভাস দিলেন উদ্যোক্তারা। এদিকে চীন ও ভিয়েতনামে ১ কেজি কুমিরের মাংস বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ ডলারে। বড় একটি কুমিরের ৮০ থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত মাংস হয়। এতে প্রতিটি কুমিরের মাংসের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের মানদণ্ড সামনে রেখেই কুমির চাষ প্রকল্পটি চলছে। তাই প্রতিটি কুমিরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে শুরু করে তাদের গুণগতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। একটি বড় কুমিরের খাবারের তালিকায় রয়েছে প্রতি সপ্তায় সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি ১ কেজি গরুর মাংস। মাঝেমধ্যে মুরগিও খাওয়ানো হয়। এই প্রজেক্টকে ইকো রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।’ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে আকিজ গ্রুপ। এজন্য পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য জমি ইজারা নেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা জানান, কুমিরের চামড়া ও মাংস রপ্তানি করতে তাদের আরও অন্তত একটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে এখন যেভাবে চলছে তাতে আগামী বছর তাদের ৫০০ কুমির রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল প্রকল্প পরিদর্শন করেছে। প্রকল্পের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেশ কিছু বিদেশি উদ্যোক্তা কুমিরের চামড়া ও মাংস নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০ কুমিরের চামড়া বিক্রয়যোগ্য।’ প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, হ্যাচারিতে ১২টি স্তরে কুমিরছানার যত্ন নেওয়া হয়। সব সময় কুমিরকে কুসুমগরম পানিতে রাখতে হয়। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ডিম পাড়ে কুমির। প্রতিটি কুমির বছরে ৫০-৬০টি ডিম দেয়। ডিমগুলো ইনকিউবেটরে ২৯ থেকে ৩৪ ডিগ্রি তাপে রাখতে হয় ৮৩ থেকে ৮৬ দিন পর্যন্ত।