শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ময়মনসিংহের কুমির যাচ্ছে বিদেশে

সম্ভাবনার হাতছানি বাগেরহাটেও

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ ও শেখ আহসানুল করিম বাগেরহাট থেকে

সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে কুমির রপ্তানিতে। ময়মনসিংহের কুমির যাচ্ছে বিদেশে। ভালুকায় ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তোলা খামার থেকে কুমির রপ্তানি করে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বাগেরহাটেও দেখা দিয়েছে নতুন স্বপ্ন। সেখানে দেশের একমাত্র প্রজনন কেন্দ্রে চাষ হচ্ছে কুমির।

ময়মনসিংহ : ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শালবনের ভিতরে উথুরা ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামে দেশ-বিদেশে আলোচিত এ কুমির প্রকল্পের উদ্যোক্তা ‘রেপটাইল্স ফার্ম লিমিটেড’। এ খামারে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আনা হয়। শুধু কুমিরের চামড়া রপ্তানিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেও এখন তারা মাংসও পাঠাবে বিদেশে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০টি কুমিরের চামড়া রপ্তানি করেছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। আগামী বছরের শেষের দিকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনে রপ্তানি হতে যাচ্ছে এই উভচর প্রাণীর মাংস। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভবিষ্যতে রপ্তানির অপেক্ষায় রয়েছে মাংস, দাঁত ও হাড়। জাপান, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব চড়া দামে বিক্রি হয়। সেখানে প্রায় ৭০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যমানের কুমিরের মাংসের চাহিদা রয়েছে। ফলে দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষে সম্ভাবনার সিংহদুয়ার খুলে দিয়েছে। গত সোমবার সরেজমিনে ফার্মে গিয়ে দেখা গেছে, খামারটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে আড়াই হাজারের বেশি কুমির রয়েছে। চলতি বছর বাচ্চা দিয়েছে প্রায় ৮০০টি। শুরুতে খামারের আয়তন ১৪ একর হলেও এখন তা গিয়ে ঠেকেছে ২১ একরে। খামারকে ঘিরে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের পাশাপাশি এ খামার এলাকায় ৫ হাজার ফলদ ও বনজ গাছের সমন্বয়ে ছায়াঘেরা নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশও রয়েছে সেখানে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৭৫টি কুমিরের মধ্যে পুরুষ কুমির ছিল ১৩টি। আনার পরের দিনই বিশেষভাবে তৈরি পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয় কুমিরগুলোকে। পরবর্তীতে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০টি কুমির বিভিন্ন কারণে মারা যায়। এরপর থেকে মৃতের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ফার্মের ব্যবস্থাপক আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ জানান, শুরুতে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রতি বছর এক হাজার কুমিরের চামড়া ও মাংস রপ্তানি করা। আমরা সে লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি।

বাগেরহাট : ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের দুবলারচরে জেলেদের জালে একটি ‘লবণ পানি প্রজাতি’র কুমির ধরা পড়ার পরই কুমিরের বংশ বৃদ্ধির প্রাথমিক কাজ শুরু করে বন বিভাগ। ২০০২ সালে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজলে ৮ একর বন নিয়ে ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারিভাবে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। শুরু হয় লবণ পানি প্রজাতির কুমির প্রজননের মাধ্যমে কুমিরের বংশ বৃদ্ধির কাজ। কুমির বাচ্চা দেয় তিন বছর পর ২০০৫ সালে। বিগত ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরে এই কেন্দ্রের ৭৫টি কুমিরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে ৭২টি বড় কুমিরের বাচ্চা সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও পাঁচটি কুমির চট্টগ্রামের ডুলহাজরা সাফারি পার্কে ও তিনটি পাঠানো হয় ভোলায়। করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রে বর্তমানে রমিয়েট নামে একটি পুরুষ, জুলিয়েট ও পিলপিল নামের দুটি মা কুমির ও ২০৬টি বাচ্চা কুমির রয়েছে। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৫ বছর। এই প্রজনন কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া কুমিরই সুন্দরবনে কুমিরের বিলুপ্তি ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ফেরুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই রাতে এই প্রজনন কেন্দ্রের সেডের নেট ভেঙে একটি ‘চিতা বিড়াল’ ৬২টি কুমিরের বাচ্চা মেরে ও খেয়ে ফেলে। এ বছর এই কেন্দ্র দুটি মা কুমির জুলিয়েট ও পিলপিলের ৯১টি ডিম পাড়লেও তা থেকে একটিও বাচ্চা ফোটেনি। পুরুষ কুমির মা কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলার স্বভাবগত আচরণ কুমিরের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। এই কেন্দ্রটির প্রতিটি প্রাণিকুলের জন্য ২৪ ঘণ্টায় সরকারি খাদ্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৬ টাকারও কম। এই অপর্যাপ্ত খাদ্য বরাদ্দের পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা। এমনকি কুমিরগুলো দেখভালের জন্য লোকবল সংকটের পাশাপাশি নেই কোনো প্রশিক্ষিত কুমির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এমনই অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সরকারিভাবে দেশের একমাত্র হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র। এরপরও করমজল প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এসব প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে। বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এই কেন্দ্রের প্রাণীর খাদ্য বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। একই সঙ্গে সরকারিভাবে প্রশিক্ষিত কুমির বিশেষজ্ঞ ও বন্যপ্রাণী চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নেই পর্যাপ্ত ওষুধ ও খাবারের সরকারি বরাদ্দ। লোকবলসহ এসব সংকট দূর হলে কুমির রক্ষায় এই কেন্দ্রটি আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।

সর্বশেষ খবর