মধ্যরাত। কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত নগরীতে তখন নীরবতা। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম। ফাঁকা রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাক। কখনো শাঁ শাঁ করে ছুটে চলছে মোটরসাইকেল, কখনো বিলাসবহুল কার। ফুল ভলিয়মের মিউজিক বাজিয়ে কালো রঙের একটি জিপ বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলছে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা। নীরব সড়ক হঠাৎ-ই সরব। ভাঙা রাস্তায় আটকে আছে রিকশার চাকা। তা তুলতেই রিকশাচালকের প্রাণান্তকর চেষ্টা। এমাথা ওমাথা করা সেই কালো জিপ গাড়িটির গতিও কমে যায়। জানালার কালো গ্লাস নামে। মুখ বের করে এক যুবকের হুঙ্কার, ‘ওই ব্যাটা, রিকশা সরা।’ অকথ্য গালাগাল। এরপরই জিপ থেকে ঠাস ঠাস শব্দ। একাধারে পাঁচ রাউন্ড গুলি! গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে। ছড়ায় আতঙ্ক। ভাঙা রাস্তায় পড়ে থাকেন রিকশা আর অটোচালক। রক্তে ভাসে রাজপথ। জিপ গাড়ি থেকে রিভলবার হাতে বেরিয়ে আসেন সেই যুবক। রক্তাক্ত দুটি দেহ দেখে জিপে গিয়ে ওঠেন। লাপাত্তা। লোকজন ছুটে আসেন। হামলাকারী কেউ নেই! শুধু পড়েছিল রক্তাক্ত দুই অসহায় ব্যক্তির দেহ। হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে মারা যান এই দুই নিরীহ মানুষ। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে রাজধানীর ইস্কাটনের রাস্তায় এভাবেই হত্যা করা হয়েছিল দুই শ্রমজীবী নিরীহ মানুষকে। এদের একজন রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও অপরজন দৈনিক জনকণ্ঠের অটোচালক ইয়াকুব আলী। মধ্যরাতে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে দুজনকে হত্যার এই ঘটনাটি নিছক ছিনতাইয়ের ঘটনা বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল। রমনা থানা পুলিশও সে রকমই তদন্ত করে। কিন্তু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর তদন্ত ন্যস্ত করা হলে নতুন মোড় নেয়। সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষাসহ তদন্তের বিভিন্ন ধাপে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত খুনির নাম। খুনির পরিচয় ফাঁস হওয়ার পর পুলিশ হতবাক। তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। খুনি আর কেউ নন, তিনি হলেন শাসকদলের সংরক্ষিত আসনের এমপি পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। পুলিশ সেই প্রাডো জিপ জব্দ করে। যার মালিক এমপি পিনু খান। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, গুলি করার পর রনির সঙ্গী-সাথীরা ভয় পায়। তাকে বলেছিল, ‘ওস্তাদ এইটা কী করলা? ঝামেলা হইব না তো?’ জবাবে তাচ্ছিল্য করে তুড়ি বাজিয়ে এমপিপুত্র রনি বলেছিলেন, ‘ধুর! কিছু হবে না, চুপ থাক। থানা-পুলিশ কেউ কিছু করতে পারব না। আমি তো আছি।’ সেই রনি এখন কারাগারে বন্দী। বিচারের মুখোমুখি। জোড়া খুনের মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আবু সালেহ উদ্দিন। পুলিশের তদন্ত, সাক্ষীদের জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে (পৌনে ২টা) বখতিয়ারকে বহন করা প্রাডো গাড়িটি নিউ ইস্কাটন রোডে যানজটে আটকে পড়ে। একটি রিকশা ভাঙা সড়কে আটকে গেলে বিপত্তি ঘটে। রিকশাচালক রিকশাটি টেনে তুলতে পারছিলেন না। এতে প্রাডোর চালকের পাশের আসনে বসা নেশাগ্রস্ত বখতিয়ার বিরক্ত হয়ে তার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে পাঁচটি গুলি করেন। বখতিয়ারের বন্ধু আবাসন ব্যবসায়ী কামাল মাহমুদ ও মো. কামাল ওরফে টাইগার কামাল ঘটনার সময় গাড়িটির পেছনের আসনে বসা ছিলেন। কামাল মাহমুদ তার জবানবন্দিতে বলেছেন, কল্যাণপুরে একটি জমির বেচাকেনা নিয়ে কথা বলতে তাকে বাংলামোটরে শ্যালে বারে ডেকে পাঠান এমপিপুত্র বখতিয়ার। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, বখতিয়ার মদ পান করছেন। বখতিয়ারের সঙ্গে আরও দুই বন্ধু জাহাঙ্গীর হোসেন ও টাইগার কামালও ছিলেন। রাত ১১টায় শ্যালে বার বন্ধ হয়ে যায়। তখন বখতিয়ার তাকে সোনারগাঁও হোটেলে মদ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বন্ধু জাহাঙ্গীরকে বলেন। এতে জাহাঙ্গীর রাজি হলে তারা চারজন (কামাল মাহমুদসহ) বখতিয়ারের প্রাডো গাড়িতে করে সোনারগাঁও হোটেলে আসেন। সেখানে বখতিয়ার, জাহাঙ্গীর ও টাইগার কামাল আবার মদ পান করেন। কামাল মাহমুদ আদালতের কাছে দাবি করেন, তার মদ পানের অভ্যাস না থাকায় তিনি পান করেননি। কামাল মাহমুদ বলেন, রাত দেড়টার দিকে তারা সোনারগাঁও হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠেন। বখতিয়ারের গাড়িচালক ইমরান ফকির গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বখতিয়ার বসেন চালকের পাশের আসনে। বাকি তিন বন্ধু পেছনের আসনে। তারা প্রথমে জাহাঙ্গীরকে মগবাজার ডাক্তার গলির সামনে নামিয়ে দেন। পৌনে ২টার দিকে নিউ ইস্কাটনে এলএমজি টাওয়ারের সামনে পৌঁছালে গাড়িটি যানজটে পড়ে। এতে বিরক্ত হয়ে বখতিয়ার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে চার-পাঁচটি গুলি ছোড়েন। এরপর মিনিটখানেক গাড়িটি সেখানে ছিল। কামাল মাহমুদ বলেন, গুলি করতে দেখে তিনি বখতিয়ারকে বলেন, ‘ওস্তাদ এইটা কী করলা? ঝামেলা হইব না তো?’ জবাবে তাচ্ছিল্য করে তুড়ি বাজিয়ে এমপিপুত্র রনি বলেছিলেন, ‘ধুর! কিছু হবে না, চুপ থাক। থানা-পুলিশ কেউ কিছু করতে পারব না। আমি তো আছি।’ পরে টাইগার কামালকে ঘটনাস্থলের একটু দূরে নিউ ইস্কাটনে এবং তাকে (কামাল মাহমুদ) হাতিরপুলে নামিয়ে দিয়ে বখতিয়ার ধানমন্ডির বাসায় ফিরে যান। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, জোড়া খুনের এই মামলার তদন্তভার রমনা থানার পুলিশের কাছ থেকে ২৪ মে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে ন্যস্ত হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ব্যালাস্টিক প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীদের আদালতে জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, তদন্ত ও অন্যান্য সূত্র থেকে ডিবি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বখতিয়ারের এলোপাতাড়ি গুলিতে দৈনিক জনকণ্ঠ-এর সিএনজিচালিত অটোচালক ইয়াকুব আলী (৪০) ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম (২৫) আহত হন। পরে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। হাকিম মারা যান ১৫ এপ্রিল বিকালে। সেদিন রাতে হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, গাড়ির জানালা খুলে একজন লোক এলোপাতাড়ি চার-পাঁচটি গুলি ছোড়ে। ইয়াকুব মারা যান ২৩ এপ্রিল রাতে। ইয়াকুবের বুকে গুলিবিদ্ধ হয় এবং হাকিমের পেছনের অংশে গুলি ঢুকে নাভির নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। গোয়েন্দারা জানান, সূত্রবিহীন এ মামলা তদন্তের একপর্যায়ে গোয়েন্দারা জনকণ্ঠ ভবনে স্থাপিত ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধারণ হওয়া ফুটেজে ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে ওই সড়কে দুবার কালো রঙের একটি প্রাডো গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৬২৩৯) বেপরোয়া চলাচল করতে দেখা যায়। গোয়েন্দারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নথিপত্র দেখে নিশ্চিত হয়, ওই গাড়িটি এমপি পিনু খানের। একই সঙ্গে গোয়েন্দারা তদন্ত, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা, অন্য সূত্রের মাধ্যমে নিউ ইস্কাটনে ঘটনার আগে এবং পরে বখতিয়ার ও ইমরানের অবস্থান নিশ্চিত হয়। বখতিয়ার তার মায়ের ওই গাড়িটি ব্যবহার করতেন। পরে তদন্ত কর্মকর্তা গাড়িচালক ইমরানকে শনাক্ত করেন এবং তার অবস্থান নিশ্চিত হন। গোয়েন্দারা ওই বছরের ৩১ মে ইমরানকে আটক করেন। তার তথ্যের ভিত্তিতে ধানমন্ডির বাসা থেকে বখতিয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই বখতিয়ারের লাইসেন্স করা পিস্তলটি জব্দ করা হয়। ৪ জুন ডিবি ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পিস্তলটি সিআইডির আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষা শাখায় পাঠায়। এই পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে এবং নিহত ইয়াকুবের শরীরে পাওয়া গুলি ও ওই পিস্তলের গুলির ধরন এক, পয়েন্ট ৩২ বোরের। ১৪ জুন প্রাডো গাড়িটি জব্দ করা হয়। নিহত রিকশাচালক হাকিমের মা ও মামলার বাদী মনোয়ারা বলেন, ‘জানি ছেলে ফেরত পামু না, তবুও হত্যার বিচার হইলে মনে কিছুটা শান্তি পামু।’ তিনি বলেন, ‘বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছাইড়া দিছিলাম। এতদিন মনে করছিলাম গরিবের জন্য বিচার নাই, কিন্তু এহন দেখলাম গরিবের পাশেও মানুষ দাঁড়ায়।’ তিনি ডিবি পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশ এক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পেরেছে বলেই বখতিয়ার আলম রনির মতো অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। গোয়েন্দারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই রনির অপরাধকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।