নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বের সংকট দ্রুত সমাধান করতে না পারলে তার সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব নিয়ে উৎকণ্ঠিত বিশ্ব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন শুধু কোনো নির্দিষ্ট দেশ নয়, হুমকিতে পড়বে পুরো অঞ্চল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা দেওয়া রাশিয়া এবং চীনও রোহিঙ্গা ইস্যুর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত। এ আশঙ্কায় আছেন জাতিসংঘ মহাসচিবও।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বড় হুমকি মনে করা ভারত সরকার রীতিমতো সে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনায় সব সদস্য দেশ এ বিষয়ে একমত যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অব্যাহত সহিংসতা চলছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আর এর পেছনে রয়েছে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা। আর এ আশঙ্কা সত্যি হলে সবার আগে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশ। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, পর্যটন, বিদেশি বিনিয়োগ, খাদ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণেই বছরে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে। বিভিন্ন দেশ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভুগবে অর্থনৈতিক খাত। তবে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা বলেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। তারা বলছে, মিয়ানমারে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ঘটনা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উঠতি অর্থনীতির বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করাও এর পেছনে অন্যতম কারণ। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ‘দেশে এখন পর্যন্ত ৯ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এর ফলে জঙ্গি ও মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।’ ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে মৌলবাদীদের মধ্যে এক ধরনের “উল্লাস” দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করতে পারে, এর ফলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হবে।’ এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান না হলে তা এ অঞ্চলের জন্য বিশেষত, চীন, ভারতসহ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য একটি প্রধান ও স্থায়ী নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে বলেও আশঙ্কা করা হয়। আবুল বারকাত বলেন, ‘প্রাকৃতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ লুটেরা গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক ধর্মীয় উগ্রপন্থি গ্রুপগুলো আগে থেকেই সক্রিয় আছে। তাই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও জনগণকে এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।’
রোহিঙ্গাদের পেছনে অর্থ ব্যয় নিয়ে ইতিমধ্যে একটি গবেষণা করেছে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। কিন্তু শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই। মিয়ানমার থেকে আসা প্রত্যেক রোহিঙ্গার পেছনে বছরে ব্যয় হবে প্রায় ১ হাজার মার্কিন ডলার। বছরে অন্তত ৫০ কোটি ডলার প্রয়োজন। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আর জাতিসংঘের (২২ সেপ্টেম্বর) হিসাবে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে ছয় মাসে অন্তত ২০ কোটি ডলার (প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) ব্যয় হবে। এর ওপর আগে আসা রোহিঙ্গারা তো রয়েছেনই।’ বিশ্লেষকদের মতে, কক্সবাজার টেকনাফ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন অঞ্চল। রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো না গেলে আসন্ন মৌসুমে পর্যটনশিল্প বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে এ অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ থমকে যাবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা চাপ ফেলবে খাদ্যে। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য সম্প্রসারণে মিয়ানমারকে লাগবে বাংলাদেশের। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে তাতে দেশটিকে পাশে পাওয়া আপাতত সহজ হবে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের খাওয়া ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে জাতীয় বাজেটে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের যে বাজেট আছে তা খুবই অপ্রতুল। কারণ, বাজেট প্রণয়নের সময় রোহিঙ্গা ইস্যুটি ছিল না। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রকল্প কাটছাঁট করতে হবে।’জঙ্গিবাদ, অর্থ পাচার ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ : ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, রোহিঙ্গারা দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’। সরকার বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা পিটিশনের জবাবে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এ বক্তব্য দিয়েছে। রোহিঙ্গারা অর্থ পাচার ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ভারতীয় সরকারের দাবি, ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ভারতে চলে আসে এবং বসবাস করতে শুরু করে। এ ছাড়া গোয়েন্দা ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ পাকিস্তানভিত্তিক ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।’ ভারতীয় বৌদ্ধদের ওপর এসব ‘চরমপন্থি’ রোহিঙ্গারা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে নয়া দিল্লি সরকার।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মধ্যস্থতা করবে না ভারত : রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করার পরিকল্পনাই নেই ভারত সরকারের। তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোঙ্গািদের জন্য সে দেশের সরকারকে মানবিক সহায়তা দেবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এক বিবৃতি দিয়ে এ কথা জানানো হয়েছে। খবর দৈনিক স্পুটনিক ইন্টারন্যাশনালের। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘আমরা “অপারেশন ইনসানিয়াত”-এর অধীন মানবিক সহায়তা প্রদান করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছি এবং আমরা সেখানে তিন দফা ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছি। চাল, ডাল, বেবিফুডসহ হাজার হাজার ফ্যামিলি প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে এবং এ জিনিসগুলো মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের পরিবারের প্রয়োজনে লাগবে।’ রবীশ কুমার আরও জানান, ‘ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই নিজেদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উন্নয়নের ব্যাপারে তারা সমন্বয় সাধন করছে। আমরা বাংলাদেশকে সহায়তার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং এ সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমরা (ভারত) সম্পূর্ণ সমর্থন প্রদান করছি।’ রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ভারতকে তার প্রভাব খাটানোর জন্য বাংলাদেশের তরফে আহ্বান জানানো হয়েছিল বলে খবর।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের এই মন্তব্য। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কয়েকটি জায়গায় হিন্দু নাগরিকদের গণকবরের যে সন্ধান পাওয়া গেছে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, ‘আমরা গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা হিন্দুদের এই গণকবর দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছি এবং সে দেশের স্টেট কাউন্সিলের কার্যালয় থেকে জারি করা এ সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তিটিও আমরা দেখেছি। আমি একটা কথা বলতে পারি যে, আমরা সকল প্রকার সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা আশা করি, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হবে।’ উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার কারণে কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। তবে গত আগস্টের শেষে নতুন করে সহিংসতা তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।