শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ফেরতের প্রস্তাব মিয়ানমারের

ঢাকায় সু চির মন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক, ফেরাতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা ফেরতের প্রস্তাব মিয়ানমারের

রাজধানীতে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে সু চির দফতরের মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ের বৈঠকের মধ্যেও থেমে নেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ (ডানে) —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। ঢাকা সফরে এসে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ে গতকাল বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মিয়ানমার সরকারের এ আগ্রহের কথা জানান। জবাবে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশ নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া তুলে দেওয়া হয়েছে মিয়ানমারের মন্ত্রীর হাতে। কবে থেকে কোন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে সে বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের বিষয়েও সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বা মিয়ানমারের ক্ষতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মাটিতে কোনো ধরনের জঙ্গি তত্পরতা চালানোর সুযোগ নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে মিয়ানমারকে। এ বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য শিগগিরই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন মিয়ানমার সফরে। রবিবার মধ্যরাতে ঢাকা সফরে আসা মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে মিয়ানমারের মন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করার আগে বৈঠক সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। এমনকি মিয়ানমার থেকেও এ বিষয়ে গতকাল কিছুই বলা হয়নি।

গতকাল বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আলোচনায় বসেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘অত্যন্ত ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে মিয়ানমার। এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দুই দেশের একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাবে আমরা উভয়ে (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) সম্মত হয়েছি। এই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কম্পোজিশন কী হবে সেটি আমরা বাংলাদেশ ঠিক করব, ওরাও (মিয়ানমার) ঠিক করবে। সম্মতিটা হয়েছে এই বৈঠকে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য বাংলাদেশ একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করেছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে ওই চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ‘নিরাপত্তা সহযোগিতার’ বিষয়েও ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্ব গণমাধ্যমের আগ্রহের কথা এবং এ বৈঠকে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তের কথা জানালেও কোনোটিরই কোনো সময়সীমার কথা জানাতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। কবে থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের এই প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং সেখানে নতুন আসা রোহিঙ্গা, না পুরনো রোহিঙ্গারা ফেরত যাওয়ার সুযোগ পাবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওই যে বলে না, ঘোড়ার আগে গাড়ি, নাকি গাড়ির আগে ঘোড়া। আসলে একটা সভা দিয়ে তো সব সমাধান হবে না। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপটা তৈরি করতে হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে দেব, ওরা ওদের পক্ষ থেকে দেবে।’ ‘যে বিষয়গুলো বাকি রয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান খুব তাড়াতাড়ি করা যাবে’ বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রশ্ন ছিল, কবে থেকে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ শুরু করবে। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু বলেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবকে পাশে নিয়ে সাংবাদিকদের মন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা যেটা বলে আসছি প্রথম থেকে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে চাই। দুই পক্ষই তাতে একমত হয়েছে। এতে কোনো বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটবে না।’ জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা থাকছে কি না—জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে জাতিসংঘ আসবে না। আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিষয়টি সমাধান করব। প্রত্যাবর্তনের শনাক্তকরণের কাজ করবে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ।’

এর আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার জন্য রবিবার রাত ১টার দিকে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় পৌঁছান মিয়ানমারের মন্ত্রী কিয়াও তিন্ত সোয়ে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার) মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী তাকে স্বাগত জানান। এ সময় ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান এবং ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত উ মিন্টসহ দুই দেশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। একই কর্মকর্তারা বিকালে মিয়ানমারের মন্ত্রীকে বিদায়  জানান।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বর্বর নির্যাতনের কারণে ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টায় রয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশ থেকে ফিরে যেতে না পারে এ জন্যই সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে সব আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুই ব্যাটালিয়ন সেনা মোতায়েন রেখেছে মিয়ানমার। পাশাপাশি ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ বার মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এসব বিষয়ই আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসীন বলেন, ‘আশার কথা হলো, মিয়ানমারের একজন মন্ত্রী অন্তত রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার জন্য ঢাকায় এসেছেন, বাংলাদেশের কথা শুনেছেন। একটা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কথা বলা হয়েছে। এটাও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, এ বিষয়গুলো যেন সময়ক্ষেপণের কোনো মাধ্যম না হয়ে যায়। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বার বার এমন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি মিয়ানমার। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ছাড়া শুধুই দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ ধরনের আলোচনায় ফলাফল পাওয়ার আশা খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ।’

সর্বশেষ খবর