শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আইন মানছে না মিয়ানমার সেনারা

সমুদ্র ও স্থল সীমান্তে থামছে না রোহিঙ্গা স্রোত

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, টেকনাফ ও উখিয়া থেকে

আইন মানছে না মিয়ানমার সেনারা

বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে গতকাল মিয়ানমার বাহিনীর এক সদস্যের প্রহরা —রোহেত রাজীব

আন্তর্জাতিক চাপ ও আইন উপেক্ষা করে মিয়ানমারের সেনারা সীমান্তে যা খুশি তাই করছে। সীমান্তে তারা প্রতিনিয়ত স্থলমাইন পুঁতে রাখার পাশাপাশি কাঁটাতারে বৈদ্যুতিক সংযোগও দিচ্ছে। এরই মধ্যে তারা কয়েক দফা লঙ্ঘন করেছে বাংলাদেশের আকাশসীমা। হেলিকপ্টার দিয়ে সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে আগুন দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনে দুই দেশের সীমান্তের ৮ কিলোমিটারের ভিতরে সেনাবাহিনীর কোনো যান চলাচল ও সামরিক টহল দিতে পারে না। কিন্তু বার্মিজ সেনারা প্রতিনিয়ত এটা করছে। এদিকে প্রতিদিনই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। গত চার দিনে অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এ স্রোত কবে থামবে কেউ জানে না। রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামের সীমানাগুলোয় পুশইন ঠেকাতেও নতুন করে তারকাঁটার বেড়া দেওয়া হচ্ছে। ওইসব এলাকায় সশস্ত্র অবস্থায় সেনাবাহিনী ও বিজিপি টহল দিচ্ছে। গতকাল সীমান্তবর্তী গ্রাম সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য কাঁটাতারের কাছাকাছি এসে সশস্ত্র টহল দিচ্ছে। তাদের কাছেই রয়েছে একটি মালামাল পরিবহনের গাড়িও। কয়েকজন সেনা সদস্য মোটরসাইকেলযোগে ঘুরছে এদিক-সেদিক। আবার কয়েকজন সেনাকে দেখা গেছে কাঁটাতারের কাছে বসেই দুপুরের আহার করতে। এভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করে সারা দিন সীমান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। একইভাবে রাতেও তারা সীমান্তে পাহারা বসিয়ে থাকে বলে স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে। যদিও সীমান্তে থাকার কথা মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি)। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে সকাল-সন্ধ্যা ও রাতে সে দেশের সেনা সদস্যরাই সীমান্তে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, আশারতলী, ফুলতলী, ঘুমধুমের জলপাইতলী, আজোহায়্যাসহ সীমান্তের অন্তত ১২টি পয়েন্টে। গত দুই সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সশস্ত্র টহল দিয়ে যাচ্ছে এসব পয়েন্টে। সেনা সদস্যরা সরাসরি সীমান্তে কাঁটাতার বসানোর কাজে যোগ দিয়েছে। একই সঙ্গে কাঁটাতারে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন ও সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখছে যাতে রোহিঙ্গারা আর ফিরে যেতে না পারে। এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের কাছাকাছি এসে কয়েক দফা কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন ও মেরামতের কাজ চালিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমার সেনারা হেলিকপ্টার নিয়ে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এ বিষয়ে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসকে তলব করে একাধিকবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগও করেছে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সু চি সরকার। এদিকে পাল্লা দিয়ে চলছে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। গত চার দিনে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নতুন করে আরও অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশে। সর্বশেষ গতকাল ও পরশু উখিয়ার লম্বাবিল, আঞ্জুমানপাড়া, থাইংখালী, টেকনাফের হ্নীলার উনছিপ্রাং, দক্ষিণপাড়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জলপাইতলী, তুমব্রু, বড় ছনখোলাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে এবং ভোরবেলায় দলে দলে রোহিঙ্গা ঢুকতে দেখা যায়। একই সঙ্গে সমুদ্র সীমান্তের নাফ নদের ওপার থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও উখিয়ার ইনানী বীচ সমুদ্রসৈকত দিয়ে নৌকা ও ট্রলারযোগে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সমুদ্রসৈকত দিয়ে নির্জন রাতের আঁধারে শাহপরীর দ্বীপের পাশাপাশি ইদানীং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও ইনানী বিচ হয়ে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার নৌকাডুবির ঘটনায় একশ্রেণির দালালের খপ্পরে পড়ে অকালমৃত্যুর শিকার হয়েছেন রোহিঙ্গারা। এখনো জ্বলছে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাড়াগুলো। আগুন ছড়িয়ে পড়তে হেলিকপ্টার থেকে দাহ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে। রোহিঙ্গা এলাকাগুলোয় বাড়িঘর ছাড়াও গাছপালা ও পাহাড়গুলো পুড়ে লালছে আকার ধারণ করেছে। গতকালও সীমান্তের ওপারে পাড়াগুলোয় আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। দুই দিন আগে বাংলাদেশে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দেশত্যাগ করে পালিয়ে আসার সময়ও রোহিঙ্গারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। হোসনে আরা নামে এক মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মিয়ানমারের বুসিদং থানার নাইরের খোয়া গ্রাম থেকে হেঁটে আট দিন পর বাংলাদেশ সীমান্তে আসেন তিনি। সঙ্গে স্বামী, চার সন্তানসহ সহযাত্রী ছিল প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু। ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে যখন যাত্রা করলেন, হোসনে আরার কোলে তখন মাত্র ছয় দিনের নবজাতক। চেষ্টা সত্ত্বেও নবজাতকটিকে কোনোভাবেই বাঁচাতে পারলেন না মা হোসনে আরা। কান্না আর শোক ভুলে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে শিশুটির দাফন শেষে আবারও যাত্রা করেন। পথিমধ্যে মিয়ানমারের মগ ও চাকমাদের হাতে দুই দফা লুটপাটের শিকার হন তারা। অস্ত্রের মুখে লুটেরা দল হোসনে আরার কাছ থেকে টাকাপয়সা, গয়নাগাটিসহ সর্বস্ব লুটে নেয়। এ ঘটনা শুধু একজন হোসনে আরারই নয়, ওই দলে থাকা হাজারো নারীর।

সর্বশেষ খবর