বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এপারে ওপারে কত রোহিঙ্গা

নতুন অনুপ্রবেশ পাঁচ লাখ সাত হাজার : জাতিসংঘ হ স্থানীয় সূত্র বলছে ১০ লাখের বেশি

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে

এপারে ওপারে কত রোহিঙ্গা

কক্সবাজারের বালুখালীতে গতকাল ত্রাণের অপেক্ষায় কাদামাটিতে বসে পড়লেন নারী —রোহেত রাজীব

স্রোতের মতো প্রতিদিনই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত একদিনের জন্যও তাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার ১৪৩ কিলোমিটার স্থল সীমানার অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে নানা কৌশলে আসছে তারা। গতকাল পর্যন্ত এর সংখ্যা কত তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। আবার আরাকান রাজ্যেই বা এখন কত রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তারও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই কারও কাছে। স্থানীয় জনসাধারণ ও বেসরকারি এনজিও কর্মীরা বলছেন, নতুন করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা আগের রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৫ লাখেরও ওপরে। অবশ্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) সর্বশেষ গত রবিবার বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৪ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর এই পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জরিপ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার বাংলাদেশ প্রধান সংযুক্তা সাহানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমরা কক্সবাজারের চার উপজেলায় ইউএনএইচসিআরের ৩৫ হাজার তাঁবু এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ১৭ হাজার ৮০০ তাঁবুতে নিজস্ব লোকবল দিয়ে জরিপ চালিয়ে এ সংখ্যা নিরূপণ করেছি। এদের মধ্যে ৩৭ ভাগ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ৩৪ ভাগ এসেছে সমুদ্রপথে নৌযোগে।’ স্থানীয় সর্বসাধারণ বলছেন, ইউএনএইচসিআরের বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা গহিন পাহাড়ে তাঁবু গেড়ে বসবাস করছেন। আবার রাস্তার ধারেও কেউ কেউ রাত কাটাচ্ছেন। একটি অংশ নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও অবস্থান নিয়েছেন। আরও একটি বিশাল অংশ বৃহত্তম চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী ৩০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু কক্সবাজার ছাড়ার সময় বিভিন্ন চৌকি থেকে আটক করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আরও অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘আমার এক ইউনিয়নেই বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ছয় লাখ। আমার মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এখনো সেই স্রোত থামেনি। প্রতিদিন তুমব্রু ও পালংখালীর বিভিন্ন সীমান্তে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’ এদিকে আরাকান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, ওই রাজ্যে এখনো বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে রয়েছে অন্তত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তারা বলছেন, মিয়ানমারে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা স্বীকৃত শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন। তবে সবগুলো তথ্যই ধারণা নির্ভর। কেউই কোনো জরিপ করেনি। অবশ্য সেই অনুকূল পরিবেশ এখনো হয়নি বলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট চরমে। তাদের জীবন এখন বিপন্ন প্রায়। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত দিয়ে স্রোতের মতো অনুপ্রবেশ করছে। গেল সপ্তাহেই প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার করে ৭০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি সংস্থা এই সংখ্যাটি আমলে আনছে না। তারা তাদের পূর্ব ঘোষিত সংখ্যাতেই রয়ে গেছে। নতুন করে যে যুক্ত হচ্ছে তার কোনো হিসাব সংস্থাগুলো স্বীকার করছে না। এদিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা নিবন্ধন কর্মসূচি চালু করেছে। মোট কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে তা এই নিবন্ধন কার্যক্রম শেষে নিশ্চিত করে হয়তো বলা যাবে। ফলে রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা কত—তা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনেও রয়েছে বিভ্রান্তি। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া কার্যক্রমে এ পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে। নিবন্ধনে সাড়া দিচ্ছে না রোহিঙ্গারা। তাদের পরিচয়পত্রে জাতীয়তায় রোহিঙ্গা শব্দটি না থাকায় বয়ষ্করা এতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। কক্সবাজারের প্রবীণ শিক্ষক এম এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কক্সবাজার শহরসহ আশপাশে এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে রোহিঙ্গা নেই। ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই বিভিন্ন কর্মসংস্থানে নিজেদের সম্পৃক্ত করা শুরু করেছে। তাতে মনে হয় কক্সবাজারে এরই মধ্যে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর