হারলেই বিশ্বকাপ শেষ। ক্যারিয়ারে আর হয়তো কখনোই ফুটবল মহাযজ্ঞে খেলা হতো না। দিয়াগো ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা হয়েও হতো না তার নাম। কিংবা সমালোচকরা বোলতার হুল ফুটিয়ে বলতেন, তুমি শুধুই ক্লাব ফুটবলার! বার্সেলোনার ফুটবলার! আর্জেন্টিনা কিংবা বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে খেলার কোনো সামর্থ্য বা যোগ্যতা নেই! ইকুয়েডরের বিপক্ষে জীবন বাজির ম্যাচটি খেলতে নামার আগে হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। বুঝে গিয়েছিলেন দুটো রাস্তা খোলা তার সামনে। হয়তো মহাবীর, জাতীয় নায়ক। নতুবা পাহাড়সম চাপের ভারে নুইয়ে খলনায়ক! ম্যাচের আগের রাতে তাই হয়তো নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন ঈশ্বরের কাছে, যেন মুগ্ধতা ছড়ানোর ক্ষমতা দেন তাকে। ফুটবল ঈশ্বর তাকে হতাশ করেননি। হতাশ করেননি বলেই জাদুর বাক্স খুলে বাঁ পায়ের স্কিলে মোহগ্রস্ত করে রাখেন গোটা বিশ্বকে। এমন জাদুই উপহার দেন, যার কার্পেটে চড়ে সব শঙ্কা, সংশয়, হতাশাকে আন্দিজ পর্বতে আছড়ে ফেলে রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট তুলে দেন প্রিয় জন্মভূমি আর্জেন্টিনাকে। মেসি এখন নায়ক, মহানায়ক। লিওনেল আন্দ্রেজ মেসির জাদুকরি হ্যাটট্রিকে ৩-১ গোলে ইকুয়েডরের কফিনে পেরেক ঠুকে জুয়ান পেরনের দেশ, ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনার কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর বুক থেকে এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলেন হাজারমনী পাথর! শান্তি! চির শান্তি এখন আর্জেন্টিনার আকাশে-বাতাসে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ব্যক্তি এখন মেসি। মেসির মোহকী ফুটবলে যখন আনন্দে ভাসছে আর্জেন্টিনা, তখন আন্দিজ পর্বতের পাদদেশের দেশ চিলিতে চলছে মরাকান্না। টানা দুইবারের কোপা আমেরিকা কাপ চ্যাম্পিয়ন চিলিকে এবার দর্শক হয়েই থাকতে হবে। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়া সরাসরি বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছে। পয়েন্ট টেবিলের পঞ্চম দল পেরু খেলবে প্লে অফ। পেরুর সমান ২৬ পয়েন্ট হলেও গোল পার্থক্যে চিলি ছয় নম্বরে। লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে চিলিকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নেইমারের ব্রাজিল। উরুগুয়ে ৪-২ গোলে হারিয়েছে বলিভিয়াকে, পেরু ড্র করেছে কলম্বিয়ার সঙ্গে। ছিটকে পড়ার তালিকায় সবার উপরে থাকা আর্জেন্টিনা ১৬ বছর পর ইকুয়েডরের মাটিতে অবিশ্বাস্য জয় তুলে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে এখন টেবিলের তিনে। ইকুয়েডরের রাজধানী কিটোর যে মাঠে খেলা হয়েছে, সেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩ হাজার মিটার বা ৯ হাজার ফুট উপরে। শ্বাস নিতে যেখানে কষ্ট, সেই কিটোতে গত ১৬ বছরে কখনোই জিততে পারেনি ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। পর্বতসমান চাপে যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন অনেকেই ভাবছিলেন ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের পর ফের দর্শক হয়ে থাকতে হবে আর্জেন্টিনাকে। ম্যাচের ৪০ সেকেন্ডে যখন স্বাগতিক ইকুয়েডর গোল করে বসে, তখন আর্জেন্টিনার আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে পড়েছিল। স্বাগতিকরা এগিয়ে যাওয়ার পরও বিন্দুমাত্র ঘাবড়াননি বিশ্বসেরা ফুটবল জাদুকর। মাথা ঠাণ্ডা রেখে জাদুরা প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে শুরু করেন। ১২ মিনিটে প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসীকে জাদু দেখান। বলকে বুটের সঙ্গে বেঁধে ড্রিবল করে বাঁ প্রান্তে বাড়িয়ে দেন অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াকে। মারিয়াও ক্ষীপ্রতার সঙ্গে মাইনাস করেন আগুয়ান মেসিকে। মেসি এরপর বাঁ পায়ের টোকায় সমতা ফেরান ম্যাচে, আবার বাস্তবতার জগতে ফিরিয়ে আনেন কালো মেঘে ঢেকে পড়া আর্জেন্টিনাকে (১-১)। সমতা এনেই বলটি জাল থেকে নিজেই নিয়ে ছুটলেন সেন্টার পয়েন্টে। বল নিয়ে যখন ছুটছিলেন, তখন যেন সতীর্থদের বলছিলেন, আজ আমার দায়িত্ব। তোমরা কেবল দেখে যাও! ২০ মিনিটে ফের জাদু। এবার কারও সাহায্য নিলেন না। একাই জাদু প্রদর্শন। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে ডি বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে কাঁটা-কম্পাসে মাপা শটে পাঠালেন জালে (২-১)। এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ খেলার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। প্রথমার্ধ শেষ আর্জেন্টিনার এগিয়ে যাওয়ার ফল নিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে স্বাগতিক ইকুয়েডর চেষ্টা চালাচ্ছিল ম্যাচে ফিরতে। কিন্তু দিনটি যে মেসির। কিভাবে ইকুয়েডর ম্যাচে ফিরে। অবশেষ ৬২ মিনিটে শেষ জাদুটি দেখালেন বাঁ পায়ে। মুগ্ধ সতীর্থরা, মুগ্ধ গোটা বিশ্ব। তিনি কেন বিশ্বসেরা ফুটবলার। কেন তাকে নিয়ে অনায়াসে কল্পনার জগতে চলে যাওয়া যায়, বক্সের মাথা থেকে যে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে গোলটি করে ক্যারিয়ারের ৪৪ নম্বর হ্যাটট্রিকটি পূর্ণ করেন, তখনই বুয়েন্স আইরেশসহ গোটা আর্জেন্টিনা কোটি কোটি ডেসিমল শব্দে উচ্চকিত। ওই অবিশ্বাস্য গোলে ম্যাচের রেজাল্ট আর্জেন্টিনা ৩, ইকুয়েডর ১। ফল সত্যি। সত্যি লিওনেল মেসি। মেসির জাদুকরি হ্যাটট্রিকে আর্জেন্টিনা মেসেজ ছুড়ে দিল এবার রাশিয়া বিশ্বকাপের শিরোপার ভাগিদার।