রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় আওয়ামী লীগ : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নেতা সেজে বসে থাকলে চলবে না। নির্বাচনী এলাকায় মানুষের কাছে সরকারের উন্নয়নগুলো তুলে ধরতে হবে। আগামী নির্বাচন গত দুই নির্বাচনের মতো সহজ হবে না। আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হব। আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সেটাই আমরা চাই।’ গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। দলের একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়। এরপর বক্তব্য রাখেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কাজী আকরাম হোসেন, ফখরুল মুন্সি, সুলতানা শফি, ড. হোসেন মনসুর প্রমুখ। সূত্র জানায়, বৈঠকে আগামী ১৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিতে যাওয়ার এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনী মোতায়েন চাইবে না। ইসির ওপর ছেড়ে দেবে। ইসি প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামাতে পারবে। ই-ভোটিং চাইবে ক্ষমতাসীন দল এবং সীমানা নির্ধারণে আপত্তি জানানো হবে। তবে কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। আজ আবার বৈঠক করে চূড়ান্ত করা হবে। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হোসেন মনসুর সরকারি চাকরিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা চাকরি ছাড়ার তিন বছরের আগে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না জানতে চান। তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিক্ষকতা করছেন শিক্ষকতা করুন।’ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মী ও এমপিদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আপনারা এলাকায় চামড়া নিয়ে ঘুরবেন? বহর নিয়ে মহড়া দেবেন? এতে কাজ হবে না। কার কতটুকু জনপ্রিয়তা রয়েছে, আমার কাছে সব খবর আছে। আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য সহজ হবে না। কঠিন নির্বাচন হবে। কারণ বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। আগামীতে যাকে দিয়ে জয়লাভ সম্ভব হবে তাকেই প্রার্থী করা হবে। কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের নিজ নিজ এলাকায় মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হবে। ভোট বাড়াতে হবে।’ সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও প্রধান বিচারপতির প্রসঙ্গে কোনো কথা ওঠেনি। দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রধান বিচারপতির প্রসঙ্গটি তুলতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখন আর কারও কোন কথা বলার দরকার নাই। কারণ ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এখন আর এ প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ কথা বলবেন না।’

অতীতে প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে : সামরিক শাসন ও বিএনপির আমলে বিচারপতিদের নিয়ে নানা খেলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে অতীতে অনেক কিছুই হয়েছে। এমনও হয়েছে, প্রধান বিচারপতি এজলাসে বসে আছেন, তাকে পত্রপাঠ বিদায় জানানো হয়েছে, অথচ তিনি জানেনই না। আমরা দেখলাম, একবার প্রধান বিচারপতির বয়স ৬২ থেকে ৬৫, আবার ৬৫ থেকে ৬২-তে আনা হলো। যিনি কেবল অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, ভোট চুরির জন্য প্রধান উপদেষ্টা করতে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানানো হলো। চক্রান্ত করল যাতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়ে ভোট চুরির সুযোগ করে দেন।’

প্রধানমন্ত্রী তার সূচনা বক্তব্যে পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। উর্দি পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান শুরু করেন নির্বাচনের নামে প্রহসন। হ্যাঁ-না ভোট বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। তখন থেকেই মূলত নির্বাচনের নামে দেশে প্রহসন শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের পর এরশাদ সরকারের আমলেও একই প্রহসন চলে। তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে আন্দোলন করে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করায় দেশের জনগণ খালেদা জিয়াকে দেড় মাসও ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, সামরিক শাসনের সময় বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সংসদকে কুক্ষিগত করা হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে বারবার বয়সসীমা কমিয়ে বিচারপতিদের বিদায় জানানো হয়। এজলাসে থাকা অবস্থায় একজন প্রধান বিচারপতিকে জানানো হয়, তিনি আর ওই পদে নেই। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংসদে বসানো হয়। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় লাখো শহীদের রক্তে স্নাত জাতীয় পতাকা। দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

যতক্ষণ শ্বাস আছে গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে যাব : এর আগে সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যতক্ষণ শ্বাস আছে দেশের জন্য কাজ করে যাব, গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে যাব। দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং জনগণের ভোটের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি।

তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতে জনগণের ভোটের মৌলিক অধিকার কেউ যাতে কেড়ে নিতে না পারে সেটাই আমরা চাই। জনগণের ভোটের অধিকারকে সুরক্ষিত করে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।’

প্রধানমন্ত্রী ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেমের (ই-ভোটিং) পক্ষে তার দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি দেশে ফিরে না এলে নির্বাচন হতো না,  দেশে গণতন্ত্রও ফিরে আসত না। তাই আমরা সব সময়ই চাই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক, যাতে দেশের জনগণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।’ 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরাই আন্দোলনের মাধ্যমে স্লোগান তুলেছিলাম, ‘‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’’। মহাজোট গঠন করে আমরাই প্রথম নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবি জানিয়েছিলাম। তা পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ করছে। আমরাও তাতে অংশ নেব। নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে। আমরা তা নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরব।’

বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা যতজন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলাম, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের মধ্যে প্রথমে ১০ জন বিচারপতিকে স্থায়ী না করে সরিয়ে দেয়। পরে আরও ছয়জনকে সরানো হয়। অবশ্য কয়েকজন রিট করে ওই পদে ফিরে এসেছেন।’ তিনি বলেন, নির্বাচনে জিততে বিএনপি-জামায়াত জোট এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার করে।’

গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার তার লড়াই-সংগ্রামের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টির কারণে ফের ওয়ান-ইলেভেন আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতায় যারা আসেন, তারা নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। অসুস্থ নাতি, ছেলের বউসহ সবাইকে ফেলে মামলা মোকাবিলার জন্য দেশে ফিরে আসতে চাইলে আমাকে বাধা দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার সংগ্রাম করেছি। ওই সময় দেশে ফিরলে আমাকে জীবননাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু আমি মৃত্যুকে কখনো ভয় করি না। যতক্ষণ দেহে শ্বাস আছে, ততক্ষণ গণতন্ত্রের জন্য কথা বলেই যাব। অনেকেই বলেছিল, মামলা হলে অনেকে দেশ ছেড়ে পালায়। আমি বলেছি, আমি কখনো কোনো অন্যায় করিনি, আমি পালাব কেন? আমি দেশে ফিরেই মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করব। অনেক বাধা ডিঙিয়ে আমি দেশে ফিরে এলে বিনা ওয়ারেন্টে আমাকে গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই আমার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়।’ তিনি বলেন, ‘ওই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে না এলে দেশে নির্বাচনও হতো না, গণতন্ত্রও থাকত না। রাজনীতি নিজের জন্য নয়, রাজনীতি করি জনগণের সেবা ও কল্যাণের জন্য।’

সর্বশেষ খবর