বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বর্তমান ইসিকে আস্থা অর্জনের পরামর্শ সাবেকদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্তমান ইসিকে আস্থা অর্জনের পরামর্শ সাবেকদের

আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনকে সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন করার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলকে আনতে ইসিকে কথা ও কাজে ন্যায়নিষ্ঠা (ফেয়ারনেস) দেখাতে বলেছেন তারা। সেই সঙ্গে নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ভোটে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সংলাপে সেনাবাহিনী মোতায়েন, আইন সংস্কারের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। অনেকেই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। সংলাপে সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার, সাবেক সচিবসহ ১৬ জন অংশ নেন। সিইসি কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টায় সংলাপ শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে। সংলাপ শেষে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা জানান, সব রাজনৈতিক দলের কাছে কমিশনকে আস্থা অর্জন করতে হবে। তারা যদি (দল) মনে করেন, এই কমিশন একটা ভালো নির্বাচন করতে পারবে, তখন লোকজন আসবে। ভোটের নিরাপত্তার বিষয়টি জোর দেওয়া হবে স্থানীয় পর্যায়ে। বিজিবি-র্যাব-পুলিশের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমান ইসির চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, কথা ও কাজেকর্মে ফেয়ারনেস দেখাতে হবে, যাতে আস্থা নষ্ট না হয়। কিছুটা আস্থা তো হয়েছে, এটা ধারণ করতে হবে। দরকার হলে এটাকে আরও পরিবর্ধন করতে হবে।

সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভোটারকেই দায়িত্ব দিতে হবে। ফাইভ স্টার, থ্রি স্টার নিয়ে ভোটের দিন ঘোরার দরকার নেই। এসপি, ডিসির দরকার নেই। ভোটাররাই তাদের এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। ইসি কীভাবে বিতর্কমুক্ত নির্বাচন করতে পারে এমন প্রশ্নে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে ইসির কিছু করার নেই। এটা রাজনৈতিক ইস্যু। এটা নির্ধারণ করবে রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা যে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর্মি থাকবে আইন অনুযায়ী। তিনি বলেন, আমার মনে হয়ে, ইসি একটা উদ্যোগ নিতে পারে দলগুলোর সমঝোতায়।

এতে তারা সফল হবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে সফল না হলেও কোনো দোষ ইসির থাকবে না।

তিনি বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি কমিশন যেন শক্তভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। তারা নিরপেক্ষ না থাকলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক তা কাজে লাগবে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ভোটের সময় ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করা; সেনা কীভাবে ভোটে আসবে তা ইসিকে ভাবতে হবে। তবে ভোটে সেনাবাহিনী লাগবেই। না হলে ভোটাররা আস্থা পাবে না। আরপিওতে সেনা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। কেন কিছু কিছু রাজনৈতিক দল তা চাইছে না তা আমি জানি না। কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়া ইসির দায়িত্ব। এই নির্বাচনটা অনেক কঠিন নির্বাচন হবে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন তা ইসির জন্য ডিফিকাল্ট। আরপিও ২২টি জায়গায় পরিবর্তন করতে বলেছি।

সমালোচনায় কান না দিতে বর্তমান কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বাতিলের বিরুদ্ধে ১০০ জন মানুষও রাস্তায় নামেনি, এমনকি মানববন্ধনও করেনি। কিছু জ্ঞানপাপী লোক এ নিয়ে কথা বলছে, লেখালেখি করে। ওই নির্বাচনের পর সরকারের চার বছর কেটেছে, আরেক বছর কাটলে পাঁচ বছরের টার্ম পূর্ণ করবে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেছেন, সংসদীয় আসন বা বিদ্যমান আইন যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট। এর বড় কোনো পরিবর্তন দরকার আছে বলে মনে হয় না। তবে আইনের কিছুটা পরিবর্তন এবং সংসদীয় আসনের কিছু পরিবর্তন করা লাগতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এই সাবেক কমিশনার বলেন, কমিশনের মূল লক্ষ্য থাকবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা। যেহেতু সংলাপে সব দল অংশ নিয়েছে। আমি মনে করি, তারা নির্বাচনেও অংশ নেবেন। এ জন্য নির্বাচনটা সুষ্ঠু করার উদ্যোগ কমিশনকে নিতে হবে। তিনি বলেন, একটি বড় দল নির্বাচনে না আসায় কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। এবার মনে হচ্ছে সবাই আসবে। কাজেই সে ধরনের পরিস্থিতি এবার হবে বলে মনে হয় না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একভাগ সমর্থন নেওয়ার বিধান তুলে দেওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি।

ইসির সাবেক সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে প্রযুক্তির ব্যবহার চাই। মানুষ ভোটের পরদিন ফলাফল পত্রিকায় দেখতে চায়। এটা করতে হলে প্রযুক্তির সহযোগিতা নিতে হবে। ২০০৮ সালে প্রযুক্তির যে ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা থেকে ইসি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

হালকা অনুভব সিইসির

তিন মাস ধরে ধারাবাহিক সংলাপের শেষ দিনে এসে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সদস্য ও আমলাদের পেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সূচনা বক্তব্যে সিইসি সবাইকে স্বাগত জানান এভাবে— “ফেলে আসা পুরনো দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ হলো। এ সুযোগে আপনাদের স্বাগত, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।”

তিনি বলেন, সুদীর্ঘকালের সুশৃঙ্খল চাকরি জীবনের চমৎকার সব অর্জন থেকে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট অংশটুকু আমাদের বলুন। বেশ স্বস্তি টেনেই নূরুল হুদা বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে অনেক মূল্যবান কথা শুনেছি, অনেক ভারী ভারী কথা শুনেছি। আজ আপনাদের পেয়ে অনেকটা হালকা অনুভব করছি। রবিঠাকুরের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের মানসুন্দরী কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সিইসি বলেন, ‘আজ কোনো কাজ নয়-সব ফেলে দিয়ে/ ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত-এসো তুমি প্রিয়ে,/ আজন্ম-সাধন ধন-সুন্দরী আমার কবিতা, কল্পনালতা।’ তিনি বলেন, আজ বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চাই। গল্প পরামর্শ আকারে গ্রহণ করব। যত্নসহকারে তা সংরক্ষণ করব, তা প্রয়োগ করব। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়নি বিচারপতি এম এ আজিজ কমিশন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ ও সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা উপস্থিত ছিলেন। সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা ও কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ অনুপস্থিত ছিলেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাইফুল আলম, আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, শাহনেওয়াজ ও  কমিশনের সাবেক সদস্য ও সাবেক সচিবরা সংলাপে অংশ নেন।

 

সর্বশেষ খবর