শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই মাসে দেড় হাজার শিশুর জন্ম

রোহিঙ্গা ৮০ হাজার গর্ভবতী, আগ্রহ কম জন্মনিয়ন্ত্রণে

ফারুক তাহের, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে আসা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে রয়েছেন প্রায় চার লাখ নারী। এদের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারীই গর্ভবতী। এখানে কর্মরত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মহিলাদের মধ্যে গড়ে ২০ শতাংশ নারী রয়েছেন গর্ভবতী। এ হিসাবে গর্ভবতী নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ থেকে ৮০ হাজারে। কিন্তু সরকারের প্রাথমিক হিসাবে গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যা ২১ হাজারের ওপরে। আর গত প্রায় দুই মাসে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি শিশু। এ অবস্থায় দ্রুত জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নেওয়া হলে রোহিঙ্গা শিশু জন্মের হার ভয়াবহ রকম বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে জন্ম নেওয়া শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও পরিকল্পিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং প্রয়োগ কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা দফতরের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাতটি মেডিকেল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালু করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সরেজমিন টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং এ বিষয়ে সচেতন নয় বলে তাদের শিশু জন্মের হার বেশি। রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন হওয়ার কারণে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ঘোর বিরোধী। প্রায় প্রতিটি পরিবারে অভাব-অনটন লেগে থাকলেও তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা গড়ে ছয়জন। কোনো কোনো পরিবারে রয়েছে ১০ জনেরও অধিক। প্রচলিত আধুনিক শিক্ষা লাভের কোনো সুযোগই তাদের সেখানে ছিল না। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত তিন উপজেলা মংডু, বুছিদং ও রাছিদংয়ে নেই কোনো স্কুল ও কলেজ। ফলে আধুনিক শিক্ষাবঞ্চিত এসব মানুষ অনেকটা আদিম অন্ধকারেই বেড়ে উঠেছে। একইভাবে তাদের সন্তানদেরও মক্তবে পড়ানো ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সুযোগ তেমন একটা হয়নি। অতীতে গুটিকয় শিশু-কিশোর স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পেলেও এখন তা থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা ও অন্যান্য অনেক বিষয়ে তারা রক্ষণশীল মনোভাবই পোষণ করে থাকেন। উখিয়ার থাইংখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পের একটি তাঁবুতে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা হয় মিয়ানমারের রাছিদং থেকে আসা মনু মিয়ার সঙ্গে। তিনি তার এলাকায় সেলাই ও কার্পেন্টারের কাজ করতেন। তাদের ছয়টি সন্তান রয়েছে। স্ত্রী আবারও গর্ভবতী। জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন করছেন না—জানতে চাইলে মনু মিয়া বলেন, ‘মানবসন্তানোর গর্ভরে কিএর লাই কবর বানাইয়ুম। খোদার অকুমে যা অইবার অইবো (মানবসন্তানের গর্ভধারণের স্থানকে কেন কবর বানাব। খোদার হুকুমে যা হওয়ার তা-ই হবে)।’ কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা দফতর সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে আনতে এ পর্যন্ত দেড় হাজার নারীকে তিন মাস মেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ানো হয়েছে এক হাজারের বেশি। আর দুই হাজারের মতো কনডম দেওয়া হয়েছে পুরুষদের। কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবা প্রদানে সাতটি মেডিকেল টিম মাঠে কাজ করছে। এর মধ্যে চারটি উখিয়ায় এবং তিনটি টেকনাফে। স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০০ জন। পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন করতে চালানো হচ্ছে ক্যাম্পেইন।

এদিকে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকালেও গর্ভবতী অনেক মহিলা খোলা আকাশের নিচে সন্তান প্রসব করেছেন। এ পর্যন্ত শতাধিক গর্ভবতী মহিলা খোলা আকাশের নিচে হাঁটাপথে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। অস্থায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পের তাঁবুতে আশ্রয় জুটলেও এই নবজাতক এবং প্রসূতি মায়েদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও শিশু খাদ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন নবজাতক ও প্রসূতি মায়েরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে যে ত্রাণসামগ্রীগুলো বিতরণ করা হচ্ছে, সেখানে শিশু খাদ্যের পরিমাণ খুব সামান্যই। নবজাতক ও শিশু উপযোগী  খাদ্যসামগ্রী ত্রাণ হিসেবে তেমন আসছে না বলে উখিয়ায় সরকারি ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে সন্তান জন্ম এবং গর্ভকালীন মায়ের যথাযথ পরিচর্যা না হলে নবজাতকের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মানোরও ঝুঁকি থাকে। আবার জন্মের পর মা ও শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। অক্সিজেনের অভাবজনিত কারণে শিশু হাইফোথার্মিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে মারাও যেতে পারে। তাই শিশুদের চিকিৎসা ও উপযোগী খাদ্য দুটোই জরুরি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী ও টেকনাফের লেদা-মুছনীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক মেডিকেল টিম রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আইওএম, সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল, ড্যাব, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংস্থা এখানে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। কর্মরত চিকিৎসকরা জানালেন, এখানে আসা গর্ভবতী মহিলাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরেজমিন ঘুরে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর অধিক সন্তান হওয়ার অন্য দুটি কারণ সম্পর্কে জানা গেছে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সবগুলো নাগরিক-অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এমনিতেই তারা অন্ধকারেই রয়েছেন। পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলে আসা নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে রুখে দাঁড়াতে হবে—এমন প্রত্যাশায়ও অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ অধিক সন্তান নিচ্ছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে চলমান মানবিক বিপর্যয় ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম একটি হচ্ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও মগদের ধর্ষণের শিকার থেকে নিজেদের বাঁচাতে দ্রুত গর্ভধারণ করেন মহিলারা—এমন তথ্য উঠে এসেছে টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবির থেকে। টেকনাফের মুছনী ক্যাম্পে অবস্থানরত পুরনো অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আবদুল মজিদ (৫৫) বলেন, ‘আমাদের থাকা-খাওয়ার অভাব রয়েছে তা ঠিক। এর পরও আমরা বেশি বেশি সন্তান নিচ্ছি এই ভেবে যে, ভবিষ্যতে যদি যুদ্ধ করে রাজ্যে যেতে হয়, তাহলে আমাদের লোকজন লাগবে। তাই বেশি সন্তান থাকলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ করলে আমরা যোদ্ধা পাব কোথায়!’ রোহিঙ্গাদের অধিক সন্তান হওয়ার আরও একটি ভিন্ন কারণ জানালেন পালংখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী হাফেজা বেগম (৫০)। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের হুকুমত (সেনাবাহিনী) রোহিঙ্গা নারীদের ধরে ধরে নিয়ে যায়, ধর্ষণ করে, খুন করে। কিন্তু গর্ভবতী হলে কোনো নারীকে তারা ধর্ষণ করে না। তাই একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরপরই আরেকটা বাচ্চা গর্ভে নেন মিয়ানমার নারীরা।’

সর্বশেষ খবর