রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এমপি লীগে সর্বনাশ তৃণমূল

চারজন এমপির বিরুদ্ধে অনাস্থা দলের, অনেক এমপি সংগঠন বাদ দিয়ে তৈরি করছেন নিজের বলয়

রফিকুল ইসলাম রনি

এমপি লীগে সর্বনাশ তৃণমূল

কেন্দ্রের কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও থামছে না আওয়ামী লীগের তৃণমূলের গৃহবিবাদ। আসনে-আসনে চলছে এমপি ও তাদের আত্মীয়স্বজনের ‘বিশেষ লীগের’ শাসন। এরই মধ্যে চারজন এমপির প্রতি ‘অনাস্থা’ এনে এলাকায় তাদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা। কোথাও কোথাও এমপির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদদানেরও অভিযোগ উঠেছে। এসব নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার নাটক। এলাকায় প্রভাব বিস্তার, নেতৃত্ব ধরে রাখার প্রতিযোগিতা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভারি হচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোন্দল এড়িয়ে চলতে বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডেকে সতর্ক করা হলেও থামছে না গৃহযুদ্ধ। জেলা-উপজেলায় দলে-উপদলে বহুধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঘরের শত্রুই কাল হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এমপি ও পুত্রদের ‘বিশেষ লীগের’ শাসন : রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের ৩৪ কমিটি রয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক ইউনিয়নে দুটি কমিটি কার্যকর। একটি কমিটি জেলা অনুমোদিত, আর অপরটি স্থানীয় এমপি এইচ এন আশিকুর রহমানের ‘পকেট’ কমিটি। পাশাপাশি এমপিপুত্র রাশেক রহমানের নামেও রয়েছে ‘রাশেক রহমান একান্ত কমিটি’। এমপির ‘বিশেষ’ কমিটি এবং ছেলের ‘একান্ত কমিটি’র নেতারা এতই প্রভাবশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলার সাহস কারও নেই। গত ৩০ জুলাই মিঠাপুকুরে এমপির বিশেষ কমিটির বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও জেলা নেতাদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় এভাবে— ‘জমি যার, চাষ করবে সে। মিঠাপুকুরের জমিন আশিকুর রহমানের। অর্থাৎ কে আওয়ামী লীগ করবে, কে যুবলীগ করবে, ইউনিয়ন-থানা কমিটিতে কে থাকবে তা নির্ধারণ করবেন আশিকুর রহমান। সেখানে কেন্দ্র ও জেলা নেতাদের মাতব্বরি চলবে না। কেউ চেষ্টা করলে পরিণাম ভালো হবে না। আশিকুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত যুবলীগের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান সোহাগ এ হুঁশিয়ারি দেন। কেন্দ্র বর্ধিত সভা স্থগিত করলেও এমপিপুত্র রাশেক রহমানের নেতৃত্বে ওই সভা করা হয়।

জানা গেছে, মিঠাপুকুরে ১৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের এক বছরের মাথায় কমিটি ভেঙে দেন স্থানীয় এমপি আশিকুর রহমান। পরে তিনি ঢাকায় বসে ফ্যাক্সের মাধ্যমে কমিটি করে পাঠান। বিলুপ্ত কমিটির নেতারা জেলা ও কেন্দ্রে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে আগের কমিটি পুনর্বহাল রাখা হয়। এ এলাকার সাংগঠনিক সংকট নিরসন করতে গত ৩০ জুলাই মিঠাপুকুরে বর্ধিত সভা ডাকা হয়। কিন্তু এমপি আশিকুর রহমান দেশে না থাকায় তা বাতিল করতে নির্দেশ দেন রংপুর বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক। কিন্তু এমপিপুত্র রাশেক রহমান সে নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের কমিটির লোকদের নিয়ে বর্ধিত সভা করেন। রাশেক রহমানের উপস্থিতিতে উপজেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন আলী বলেন, আজকে এখানে চক্রান্তের বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত পদদলিত করে আমরা বর্ধিত সভা করছি। এখানে আশিকুর রহমান ও রাশেক রহমানের নির্দেশে দল চলবে। কে কেন্দ্রীয় নেতা, কে জেলা নেতা তা দেখার সময় নেই। এর জের ধরে রাশেক রহমানকে সাময়িক বহিষ্কার করে কেন্দ্র। এমপি আশিকুর রহমান কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নম্বর সদস্য তিনি। তার স্ত্রী রেহেনা আশিকুর রহমান এক নম্বর সহ-সভাপতি ও ছেলে রাশেক রহমান এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। উপজেলা কমিটিতে পরিবার লীগ এবং ইউনিয়নে এমপি লীগেই চলছে দল। উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ইলিয়াস মিয়া অভিযোগ করে বলেন, মিঠাপুকুরে চলছে এমপি আশিকুর রহমান ও ছেলে রাশেক রহমানের শাসন। তারা বৈধ কমিটি ভেঙে দিয়ে নিজের মতো করে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করেছেন। কেন্দ্র ও জেলা আগের কমিটি বহাল রাখলেও তাদের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রের নির্দেশে বর্ধিত সভার জায়গা ভাড়া নিতে গেলে গত ২৫ জুলাই রাশেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন আসাদুজ্জামান সোহাগ আমাকে বেদম মারপিট করেন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলাম। তিনি বলেন, রাশেক রহমান প্রতিটি গ্রাম থেকে দুজন করে ছেলে বাছাই করে ‘রাশেক রহমান একান্ত কমিটি’ গঠন করেছেন। মূলত এ কমিটির কেউ কেউ টেন্ডার ভাগবাটোয়ারার কাজ করেন। দল ক্ষমতায় থাকলেও রূপগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেন বিরোধী দলে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী ও তার ছেলে পাপ্পা গাজীর সমর্থকদের হামলা-মামলায় ঘরছাড়া দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সহস্রাধিক নেতা-কর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। গত ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়াকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূল দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এমপির ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। লোকদেখানো সম্মেলনের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে তিনি হাইব্রিড ও বিএনপি-জামায়াতের লোকদের নিয়ে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগের কমিটি গঠন করছেন। এতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের জায়গা না দিয়ে যারা এমপিকে তোয়াজ করে, পা ধরে বসে থাকে তাদের নেতা বানাচ্ছেন। ফলে দল চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে এলাকায় ‘বিশেষ লীগ’ গঠন করতে চাইছেন। একই অবস্থা জামালপুর-১ আসনে। দলীয় কর্মসূচিতে এমপিকে পাশে পান না জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। বরাবরই দলীয় কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত তিনি। ১৫ আগস্টসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ দিবসে তাকে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ইশতেয়াক হোসেন দিদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমপিকে দলীয় কর্মসূচিতে পাওয়া যায় না। তিনি কোথায় কী করেন তা আমরা জানি না। আমাদের কোনো সহযোগিতাও করেন না। বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ চেষ্টা করে ১০৫ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইনের জন্য পাস করালেও এমপি প্রভাব খাটিয়ে তা বাতিল করে দেন। স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, পদ-পদবিতে না থাকলেও এমপি আবুল কালাম আজাদের যাবতীয় কাজকর্ম দেখেন ফোরকান ও সাখোয়াত। তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন এলাকার কাবিখা, টিআর, টেন্ডারসহ সবকিছু। 

এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষিত যেসব এমপি : ১৫ অক্টোবর নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুসকে নিজ উপজেলা গুরুদাসপুর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বয়কট করার ঘোষণা করে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী সংসদ সদস্যকে বয়কটের ঘোষণা দেন। সভায় উপস্থিত সব সদস্য হাত তুলে ওই ঘোষণায় সমর্থন জানান। বর্ধিত সভায় পৌরসভা, ছয়টি ইউনিয়ন ও ৬৭টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। গত জুলাই মাসে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে এমপিবিরোধী অংশের নেতা-কর্মীরা এনামুল হককে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি জানান। তাদের অভিযোগ, এমপি এনামুলের হাতে আওয়ামী লীগ নিরাপদ নয়। তিনি সংগঠনে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। এমপির বিরুদ্ধে জামায়াত-বিএনপি এবং জেএমবি ও সর্বহারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতারও অভিযোগ তোলা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এর জের ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু, সহ-সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধা, সদস্য আবদুস সোবহানসহ ১১ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। গত ৯ জুলাই যশোরের মনিরামপুরে ছাত্রলীগ নেতারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যশোর-২ আসনের এমপি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ আনেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে দিনাজপুর-১ আসনের এমপিকে বয়কটের ঘোষণা দেন বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা। এ ছাড়া প্রায় অর্ধশত এমপি ও তাদের স্বজনের অত্যাচারে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। পিরোজপুরে চলছে এমপি আউয়ালের শাসন। তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে নিজের ভাইসহ দলের নেতারা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেন আউয়াল। এমনকি জেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় প্রার্থী সাবেক এমপি অধ্যক্ষ শাহ আলমের বিরোধিতা করে সমর্থন দেন এক সময়ের ছাত্রদল নেতা, পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি-জেপির নেতা মহিউদ্দিন মহারাজকে বিজয়ী করেন। আরেকজন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। সেখানে দলীয় কোন্দলের মাত্রা এমন যে, জামায়াতের নাশকতার ১০ মামলায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৯৮ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। কমিটি গঠন নিয়ে বিতর্ক, টিআর-কাবিখা লুটপাট, জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন তুহিন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধেও সন্ত্রাস, টেন্ডার-নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা প্রকল্প নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। গত নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার পরই এলাকা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর আগেরবার দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কবিরুল হক মুক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। অবশ্য জয়লাভ করার পরই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তার জনপ্রিয়তায় ধস নামে। তিনি তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, দলের এমপিদের নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিপাকে আওয়ামী লীগ। আগামীতে যাচাই-বাছাই না করে মনোনয়ন দিলে সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

সর্বশেষ খবর