রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গো য়ে ন্দা কা হি নী ৫৮

খুনের সাক্ষী চাম্বল গাছ

মির্জা মেহেদী তমাল

চাচাতো বোন পপির গায়ে হলুদ। ১৪ বছরের কিশোরী জাকিয়া সুলতানা চম্পার খুশির যেন সীমা নেই। হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। আত্মীয়-স্বজন আসবে। সবার সঙ্গে দেখা হবে অনেক দিন পর। এমন ভাবনায় দুই দিন ধরে চম্পার চোখে ঘুম নেই। লালপাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি জোগাড় করতে হবে। সাজগোছের আরও কত কী! কিন্তু কিছুই জোগাড় হয়নি। আজ এই বান্ধবীর বাসায় গিয়ে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে চুরি জোগাড় তো কাল আরেক বান্ধবীর বাসায়। চম্পার মন হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। ভাবে, আজ যদি তার বাবা-মা বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো এসব নিয়ে তাকে এত চিন্তা করতে হতো না। তারাই তার সামনে হাজির করে বলতেন, ‘পরে দেখত মা, দেখি কেমন লাগে তোকে।’ এমন ভাবনা প্রায় প্রতিদিনই পেয়ে বসে তাকে। আবার নিজেই নিজেকে সামলে নেয়। সেদিন খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেই হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল চম্পা। লালপাড়ের হলুদ শাড়িতে তাকে খুব সুন্দর লাগছিল। পাশের বাড়ির খালা তাকে এমনই বলেছেন। এরপর থেকেই চম্পার মনটা খুব ভালো। মনের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে নিল। ‘ভাবী আমি সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসব। চিন্তা করো না।’ দরজার কাছে এভাবেই চিৎকার করে ভাবীকে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় চম্পা। দুপুরের মধ্যেই চাচার বাড়িতে হাজির চম্পা। বোনের হলুদের অনুষ্ঠানে চম্পা যেন মধ্যমণি হয়ে উঠল। হৈচৈ করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে। বাসায় চম্পার ভাই আর ভাবী চিন্তা করছে। তখনো চম্পা  ফেরেনি বাসায়। এতক্ষণ তো থাকার কথা নয় চম্পার! সন্ধ্যাতেই শেষ হয়ে গেছে অনুষ্ঠান। রাত হচ্ছে, এখনো আসছে না কেন? এমন নানা প্রশ্ন চম্পার ভাই-ভাবীর মনে। খুব টেনশন করছেন তারা। কীভাবে এত রাতে ফিরবে? বাসা থেকে ভাই বেরিয়ে সামনের দিকে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। বোন আসবে ওই রাস্তা দিয়েই। কিন্তু না, ফিরছে না চম্পা। ভাইয়ের মনে অজানা আতঙ্ক। খারাপ সব ভাবনা তার মাথায় এখন। ভাবছে, কোনো সমস্যা হলো না তো বোনের? কয়টা বাজে ছেলে নাকি তাকে ডিস্টার্ব করছিল বেশ কয়েক দিন থেকে। তারা আবার কোনো সমস্যায় ফেলল না তো? এসব নানামুখী চিন্তায় চম্পার ভাইয়ের মনে ভীতির সৃষ্টি করছে। আর পারছে না অপেক্ষা করতে। সে নিজেই তার সেই চাচার বাড়িতে গেল। সেখানেও নেই! সন্ধ্যা থেকে তাকে সেই বাসায় দেখা যায়নি। এমন কথা শুনে ভাইয়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। তবে গেল কোথায় চম্পা। ওই বাসা থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। নাহ, কোথাও নেই। আদরের ছোট বোনটিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না ভাই। পাগলের মতো এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে। সারারাত কাটে এভাবেই। নতুন আরেকটা দিন আসে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়। চম্পার বান্ধবীরা যায় স্কুলে। সবার সব ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু চম্পা ফেরেনি বাসায়। তাদের বাসায় তখন ভিন্ন ধরনের এক অসহ্য যন্ত্রণা। থানা পুলিশকে জানানো হয়। তারাও খোঁজখবর নিতে শুরু করে। হঠাৎ খবর আসে বাগানের বড় চাম্বল গাছে একটি কিশোরীর লাশ ঝুলে আছে। খবরটি পাওয়ার পর ছুটে যায় পুলিশ। ছুটে যায় চম্পার ভাইও। মনে মনে ভাবছিল, ঝুলন্ত লাশটি যেন অপরিচিত কারও হয়। কিন্তু দূর থেকেই চিনতে পারে সে। সেই লালপাড়ের হলুদ রঙের শাড়ি। তা দিয়েই গলা বাঁধা। ঝুলে আছে তার আদরের ছোট বোন চম্পা।

চম্পার ভাই হাসিবুল ইসলাম হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। তিনি আসামি করেন ছয়জনকে। কিন্তু তদন্তে খুনের কোনো আলামত খুঁজে পায় না পুলিশ। সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ এবং ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার আলামত দেখতে পাননি বলে মত দেন তাদের প্রতিবেদনে। একজন আসামি গ্রেফতার হলেও এমন প্রতিবেদনের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। হতাশ চম্পার পরিবার। প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন চম্পার ভাই। এরপর আরেক ইতিহাস। আদালতের নির্দেশে শুরু হয় নতুন করে তদন্ত। তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। যে গাছে চম্পাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই গাছই চম্পার মৃত্যু রহস্য খুলে দেয়। আত্মহত্যা নয়, চম্পাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। পরে তার লাশ চাম্বল গাছে ঝুলিয়ে রাখে খুনিরা। বিচারে খুনিদের ফাঁসি হয়, যারা খুনের দায় থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের ঘটনা এটি। চম্পা ফরিদপুর সদর উপজেলার কাশিমাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর মিয়ার মেয়ে এবং স্থানীয় পুরদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। ১৪ ডিসেম্বর রাতে নিজ বাড়ির পাশে সোহরাব শেখের মেহগনি বাগান থেকে চম্পার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন চাচাতো বোনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়ে নিখোঁজ হয় চম্পা। ফরিদপুর সদর থানার পুলিশের নতুন কর্মকর্তা তদন্ত করতে গিয়েই নানা অসঙ্গতি খুঁজে পান। আদালতের অনুমতি পেয়ে কবর দেওয়ার ২২ দিন পর চম্পার দেহ তোলা হয়। নতুন করে করা হয় ভিসেরা পরীক্ষা। ঢাকায় গঠিত বোর্ড হত্যার সম্ভাবনার কথা বলে। সেই সঙ্গে জননাঙ্গে বীর্যের উপস্থিতি  দেখে মৃত্যুর আগে যৌন সঙ্গমের সম্ভাবনার বিষয়টিও উল্লেখ করে। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা সেই গাছটি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেন। তিনি নিজেই বার বার গাছে চড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একজন নারী মসৃণ মোটা গাছে চড়ার প্রশ্নই আসে না। এতে করে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত হন। তিনি গাছের ছবি তুলে রাখেন আলামত হিসেবে। তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, স্থানীয় শামীম ‘প্রেমের প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে’ চম্পাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর চম্পার চাচাতো বোন পপির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের সময় আসামিরা শামীমের ভাগ্নে বাবু ও পারভীনের মাধ্যমে চম্পাকে বাড়ির পাশের একটি মেহগনি বাগানে ডেকে নেয়। সেখানে নিয়ে তারা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। চম্পা এ সময় তাদের বলে, সবাইকে সে বলে দেবে। তখন তারা গলা টিপে হত্যা করে চম্পাকে। লাশ শাড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে চাম্বল গাছের ডালে। এদিকে রাত ৯টার পরও চম্পা ফিরে না আসায় তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। পরদিন ওই বাগানে পাওয়া যায় তার ঝুলন্ত লাশ। ঘটনার আগে-পরে ২-৩টি মোটরসাইকেলে শামীমসহ অন্যদের  ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এ ঘটনার পর ১৫ ডিসেম্বর চম্পার ভাই হাসিবুল ইসলাম বাদী হয়ে ছয়জনকে আসামি করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এতে শামীমকে প্রধান আসামি করা হয়। এরপর তদন্ত শেষে কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক আবুল খায়ের শেখ দণ্ডবিধির সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যুক্ত করে ফরিদপুরের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। বিচারের জন্য তা ২০১৪ সালের নভেম্বরে আসে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুর রহমান সরদার আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। চম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে শামীম মণ্ডল (২৪), বাবুল  হোসেন ওরফে রাজিব হোসেন ওরফে বাবু হোসেন মাতুব্বর (২২), জাহিদুল হাসান ওরফে জাহিদ সরদার (২৪) ও আকাশ মণ্ডলের (২৪) ফাঁসির রায় দেন। আসামিদের মধ্যে আকাশ ও বাবুল হোসেন পলাতক। বাকিরা কারাগারে। রায় পড়ার মাঝামাঝি এসে বিচারক দুটি ফটোগ্রাফ আসামি পক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের হাতে দিয়ে তা দেখতে বলেন। ছবিতে একটি গাছের উপরের দিকের ডালে গায়ে হলুদের হলুদ শাড়ি ও লাল পেটিকোট পরা অবস্থায় ঝুলন্ত চম্পাকে দেখিয়ে বিচারক রহমান সরদার বলেন, ‘আমরা যারা সক্ষম পুরুষ, আমাদের পক্ষেও লুঙ্গি-প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় এ ধরনের মসৃণ-গোলাকার চাম্বল গাছে ওঠা সম্ভব নয়। নিহতের আত্মহত্যার জন্য একা একা শাড়ি-পেটিকোট পরে গাছে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কস্মিনকালেও তা সম্ভব নয়। নিহতের পেছনের দিক থেকে তোলা ছবিটিতে শাড়িটি  যেভাবে ছেঁড়া দেখা যায়, তা কেবল ধস্তাধস্তির ফলেই সম্ভব।’ এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৩০ জন সাক্ষ্য দিলেও  কোনো চাক্ষুস সাক্ষী ছিল না উল্লেখ করেই বিচারক বলেছেন, ছিল পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং আসামি বাবুল হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবুল হোসেন স্বীকার করেন, ধর্ষণের পর চম্পা যখন ঘটনাটি বলে দেবে বলে জানায়, তখন তারা চারজন চম্পাকে কাপড়ের গিঁট দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। ঘটনাটি খুবই নির্মম, নির্দয়, নৃশংস ও অগ্রহণযোগ্য। ফলে এ ধরনের মামলায় আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ জাতীয় অভিশাপ থেকে সমাজ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কোনোমতেই আসামিদের অনুকম্পা দেখানো সম্ভব নয়,’ সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মামলার রায়ে বলেন বিচারক। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

সর্বশেষ খবর