রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাখাইনে ফিরে যেতে চায় রোহিঙ্গারা

ফারুক তাহের, তুমব্রু (বান্দরবান) ও উখিয়া (কক্সবাজার) ঘুরে

আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমান সরকার কিছুটা নমনীয় হওয়ায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা গোপনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যাতায়াতের চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গারাও নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চান। তবে চান তাদের অধিকার এবং রোহিঙ্গা ‘মুসলিম’পরিচয়। অনেকে ফেলে আসা ভিটেমাটিতে নতুন করে বসতি নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ দুই দেশের সঙ্গেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। আবার যারা নিজেদের ভিটে-বাড়ির খোঁজ নিতে ওপারে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকে নিখোঁজ হচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক নানা চাপে গত দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপির তেমন টহল নেই। নেই হেলিকপ্টার থেকে দাহ্যপদার্থ ফেলে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালানোর সামরিক অভিযানও। ফলে সীমান্তবর্তী আগুনে পোড়া রোহিঙ্গা পাড়াগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখতে ঝুঁকি নিয়ে ওপারে পার হচ্ছেন কেউ কেউ। বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দু-চারজন করে একেকটি দলে ভাগ হয়ে রোহিঙ্গা পুরুষ ও শিশুরা মিয়ানমারের মংডুতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ মাথায় লাকড়ির বোঝা ও কাঁধে কাঠের টুকরা নিয়ে কাঁটাতার ডিঙিয়ে আসছেন এ পারে। দুই মাস ধরে দুই দেশের শূন্যরেখায় তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান নেওয়া এই রোহিঙ্গারা সীমান্তবর্তী তাদের ভিটেবাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেছেন। আবার অনেকে রাতের আঁধারে রাখাইনে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা সহায়-সম্পদ ও গবাদি পশু লুট করে নিয়ে আসছে—এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। কথা হয় তুমব্রুর বাংলাদেশ সীমানায় রোহিঙ্গা আবদুল আজিজের (৭০) সঙ্গে। এই বৃদ্ধ জানান, এবারসহ তাকে চারবার পালিয়ে আসতে হয়েছে। প্রতিবারই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু এবার দীর্ঘদিন ধরে থাকতে হচ্ছে ‘জিরো পয়েন্টে’। এরইমধ্যে তিনি দুবার মংডুর বলিবাজার এলাকায় নিজেদের বাড়িঘর দেখতে গিয়েছেন। কিন্তু গিয়েই নিজের ভিটে-বাড়ি নিজের কাছেই অপরিচিত ঠেকেছে। ভয়ে-দুশ্চিন্তায় শিউরে ওঠেছেন। পোড়া ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নেই সেখানে।

তিনি বলেন, ‘ভোর বেলার দিকে কাঁটাতার পার হয়ে ২০-২৫ মিনিট হেঁটে বাড়িতে পৌঁছি। আগুনে পোড়া বাড়িঘরের চেহারা দেখে আমি কান্না করলাম কিছুক্ষণ। কিছুই নেই সেখানে। সব পুড়ে একাকার হয়ে গেছে। থাকার সাহস পেলাম না বলে চলে আসলাম।’

এদিকে উখিয়ার পালংখালী শফিউল্লাহ কাটা অস্থায়ী ক্যাম্পের আশ্রিত রাখাইনের বলিবাজারের কোরবান আলী, মাস্টার আবদুর রাজ্জাক ও মমতাজ মিয়া পরিবার নিয়ে সপ্তাহ-দশ দিন আগে চলে গেছেন। পালংখালী তাজনিমার খোলা থেকে গোপনে রাখাইনের কুমিরখালী গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে গুরা মিয়া, উলা মিয়া, লালু মিয়া ও নবী হোছনের পরিবারও চলে গেছে। মিয়ানমারের বিজিপির সঙ্গে আঁতাত করে মংডুর ফকিরাবাজারের রেইক্যাপাড়া, বদলাপাড়ার খাইরুল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবুল ওসমান, মফিজ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন বালুখালীর অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে গোপনে চলে গেছে বলে জানা গেছে। এভাবে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে সীমান্তের কাছের কিছু রোহিঙ্গা পরিবার চলে যাচ্ছে তাদের ভিটেমাটিতে। যারা চলে যাচ্ছেন এদের অনেকে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিতও হয়েছেন। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য এখানে থেকে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সুবিধাও অব্যাহত রেখেছেন। তারা মূলত বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দুই দেশের সুবিধা গ্রহণ করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মৌলভী আবদুল খালেক জানান, এরই মধ্যে কিছু কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মংডু, রাছিদং ও বুছিদং গিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ফেলে আসা সহায়-সম্পদ লুট করে নিয়ে এসে এপারে বিক্রি করার কাজে নেমেছে। যারা বিজিপির সঙ্গে যোগসাজশ না রেখে ওপারে যাচ্ছে, তাদের কেউ কেউ বিজিপির হাতে প্রাণ দিচ্ছে। এ ধরনের অনেকেই এখন নিখোঁজ রয়েছে। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ নূর ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প কমিটির সভাপতি লালু মাঝি জানান, লাখ লাখ রোহিঙ্গারা এখানে রয়েছে। কে কোন দিকে কোথায় যাচ্ছে সে খবর রাখার সুযোগ আমাদের নেই। তবে শুনেছি—কেউ কেউ আবার ওপারে চলে যাচ্ছে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, কোনো রোহিঙ্গার চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে প্রভাবশালী কোনো কোনো রোহিঙ্গার সঙ্গে সে দেশের সেনা ও বিজিপির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকেত পারে। এর ভিত্তিতে গমনাগমন হতে পারে।

সর্বশেষ খবর