সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টায় ১১ জনের ২০ বছর করে জেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ঘটনার দুই মামলায় বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার আবদুর রশীদসহ ১১ আসামিকে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির গতকাল দুই দফায় এই দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

হত্যাচেষ্টার মামলায় ১১ আসামির প্রত্যেককে ২০ বছরের কারাদণ্ড ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তাদের সবাইকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। অপরাধজনক ষড়যন্ত্র, প্ররোচণা, অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা এবং হতাচেষ্টার দায়ে ফ্রিডম পার্টির এই নেতা-কর্মীদের সাজা দেয় আদালত। আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বাড়িতে গুলি ও বোমা হামলার ঘটনায় এই মামলা করা হয়। তদন্ত করে পুলিশ হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনের দুই ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচারে সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামি হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ, মো. জাফর আহম্মদ, হুমায়ুন কবির ওরফে হুমায়ুন, মিজানুর রহমান, শাজাহান বালু, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ ও জর্জ মিয়া। অপরাধের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আসামি হুমায়ুন কবির ওরফে কবিরকে দুই মামলাতেই খালাস দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রশীদ, জাফর ও হুমায়ুন কবির ওরফে হুমায়ুন পলাতক। শাজাহান বালু জামিনে ছিলেন। তার জন্য বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পরও তিনি উপস্থিত না হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করে আদালত। তবে জামিনে থাকা মিজান, ইমাম হোসেন, কাজল রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। কারাগারে থাকা মামুন, সোহেল, মুরাদ ও জর্জ মিয়াকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। রায়ের পর তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়। বিচারক জাহিদুল কবির দুপুরে নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ এজলাসে বসে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় দেন। এরপর বিকালে জনসন রোডে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার এজলাস থেকে তিনি বিস্ফোরক মামলার রায় ঘোষণা করেন। হত্যাচেষ্টা মামলায় ১১ আসামিকে দুটি ধারায় ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় আদালত। দুটি সাজা পর্যায়ক্রমে ভোগ করতে হবে বলে আসামিদের ২০ বছর জেলে থাকতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাজার মেয়াদ থেকে হাজতবাসের সময় বাদ যাবে। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার অভিযোগপত্রে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান ও মেজর বজলুল হুদার নাম থাকলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ দুই মামলা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়। অন্য দুই আসামি রেজাউল ইসলাম খান ফারুক ও লিয়াকত হোসেন কালা মৃত্যুবরণ করায় তারাও বাদ পড়েন। এ মামলায় মোট ৬৬ কার্যদিবস বিচার কাজ চলে। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আসামি পক্ষে কেউ সাক্ষ্য দেননি।

আদালতের পর্যবেক্ষণ : রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা আর তার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একই আসামিদের, একই ষড়যন্ত্রকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, হামলার ঘটনায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি হলেও পরে তা মামলায় রূপান্তর করা হয়। ওই এজাহার ছিল দুর্বল। কিন্তু মামলার তিন আসামি পরে আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে এসেছে আসামিরা বিভিন্ন সময় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেছে এবং সেই ষড়যন্ত্র থেকেই তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে।

বিচারের জন্য ২৮ বছর : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে প্রায় ২৮ বছর পর। এর মধ্যে বিচারের অপেক্ষায় কেটে গেছে প্রায় তিন দশক। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার বাড়িতে যখন হামলা হয়, তখন তিনি বাড়িতেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতৃত্বে গঠিত দল ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীরাই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ওই হামলা চালিয়েছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে। ওই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম একটি জিডি করেন। পরে সেটি মামলায় রূপান্তর হয়। এজাহারে বলা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালায় এবং হামলাকারীরা ‘কর্নেল ফারুক-রশীদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়। ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলে, অভিযোগের প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছর ২ সেপ্টেম্বর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খালেক উজ্জামান আদালতে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে ১৬ জনকে আসামি করে দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে মামলার কার্যক্রমে আবার স্থবিরতা দেখা দেয়। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি পুনরায় ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের ৫ জুলাই মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার কার্য শুরু হয়। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলেও সাক্ষীদের হাজির করতে বিলম্বসহ বিভিন্ন কারণে বিচার কার্যক্রম বেশি এগোয়নি। পরে মামলার নথি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। তিনজন বিচারকের হাত ঘুরে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির গত ১৬ অক্টোবর দুই মামলায় যুক্তিতর্ক গ্রহণের পর রায়ের দিন ধার্য করেন।

সর্বশেষ খবর