বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্ব প্রামাণ্যের ঐতিহ্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেসকো

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বিশ্ব প্রামাণ্যের ঐতিহ্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেসকো

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ভাষণ দেন —ফাইল ছবি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। সোমবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক ঘোষণায় এ কথা জানান। গতকাল বিকালে ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এ তথ্য জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রেরণা। এ ভাষণেই জেগে উঠেছিল পুরো জাতি। এর মাধ্যমেই স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায় বাঙালিরা। এ ভাষণ বাংলাদেশে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। এখন সারা বিশ্ব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে পারবে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার উদ্যোগ হিসেবে ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেসকো। এ তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে প্রভাব থাকতে হয়, যা অনস্বীকার্য হিসেবে রয়েছে ৭ মার্চের ভাষণে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের মোট ৪২৭টি নথি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক অ্যাডভাইজরি কমিটি এ তালিকার প্রস্তাব দিয়ে থাকে। তারাই যাচাই-বাছাই করে পুরো প্রক্রিয়া। চলতি বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে বৈঠকে বসে কমিটি। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করার।

এ স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত : ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘ইউনেসকোর স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন না একদিন এ ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। আজ ইউনেসকোর এ স্বীকৃতি আমাদের সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ।’ গতকাল সচিবালয়ে সম্মেলনকক্ষে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত। তিনি সারা জীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয় সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল।

এটা বাঙালি জাতির অর্জন : আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা তো আগেই বলেছি, এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। মাত্র ১৭ মিনিটে এমন ভাষণ পৃথিবীতে কেউ কখনো দেননি। এর আগে যারা দিয়েছেন, তারা লিখিত দিয়েছিলেন। এ ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ২৩ বছরের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ছিল। কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন সবই আছে এতে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের নির্যাতনের ইতিহাসও ছিল। এ ভাষণের পর গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। দেরিতে হলেও ইউনেসকো এটাকে গ্রহণ করেছে। এজন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই। এটা বাঙালি জাতির বড় অর্জন।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মঞ্চে উপস্থিত বঙ্গবন্ধুর সহচর ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্পর্ধার স্বীকৃতি মিলেছে।’

এ ভাষণেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা : বঙ্গবন্ধুর জামাতা অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক এই স্বীকৃতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি নিজে উপস্থিত থেকে ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলাম। ওই ভাষণেই ছিল মুক্তিযুদ্ধে করণীয় সব নির্দেশনা। দেশের সর্বস্তরের মানুষকে তিনি উজ্জীবিত করে গিয়েছিলেন। তার প্রতিটি শব্দে ছিল এক একটি বার্তা। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের এবং আনন্দের।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তখন ছাত্রলীগ করতাম। সত্যি কথা বলতে এখন অনেক ক্ষেত্রে সে কথা বলতে লজ্জা হয়। তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ আমাদের নেতা ছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে যেতাম। বঙ্গবন্ধু ইলেকশনে জিতলেন। কিন্তু অ্যাসেম্বলি হলো না। তখন তিনি পূর্বাণী হোটেলে বসলেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। পরে ৭ মার্চ নির্ধারণ করা হলো।

প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদ জ্ঞাপন : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় ইউনেসকো মহাপরিচালক মিজ ইরিনা বোকোভাকে ফোনে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নাহিদ ইউনেসকো সদর দফতর প্যারিস থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তাকে অভিনন্দন জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধারাবাহিক সমর্থন দেওয়ার জন্য ইউনেসকোর মহাপরিচালক মিজ ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি ইউনেসকো সাধারণ সম্মেলনে অংশগ্রহণরত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যদেরও ধন্যবাদ জানান। মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ)-তে বর্তমানে ডকুমেন্ট ও সংগ্রহ দাঁড়াল ৪২৭টি।

 ওই দিন বিকাল ৩টায় ক্লাস চলছিল। ছাত্রনেতারা ক্লাসে এসে বললেন সবাইকে মাঠে যেতে হবে। আমরা দ্রুত মাঠে চলে গেলাম।’

অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক বলেন, ‘সেদিন মাঠে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বক্তৃতা শুনছিলাম। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন। আর্মিকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তোমরা আমার ভাই ব্যারাকে থাকো। তার অসাধারণ শব্দশৈলী এবং ভাষার গঠন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে অনেক জায়গায় গবেষণা হয়েছে। ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অতর্কিত হামলা করলে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতার পক্ষে কাজ শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে আরও আগে ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। যা হোক, তার পরও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ইউনেসকোকে ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর