বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঢাকাকে বাঁচাতে সবার মতামত নিয়ে নতুন ড্যাপ করতে হবে

রাজউকের প্রাকপ্রস্তুতি সভায় স্টেকহোল্ডাররা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকাকে বাঁচাতে সব স্টেকহোল্ডারের মতামত নিয়ে সবার সহযোগিতায় নতুন করে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ) করতে হবে। তবে ঢাকাকে বাঁচাতে সবার আগে দখলে দূষণে হারিয়ে যাওয়া ঢাকার ৫৮ খাল উদ্ধারের ওপর জোর দিতে হবে। খাল উদ্ধারে উদ্যোগ নিলে রাজউককে শতভাগ সহযোগিতা করবে বেসরকারি সংস্থাগুলো। ড্যাপ বিষয়ে গতকাল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আয়োজিত প্রাক-প্রস্তুতি সভায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা এসব মতামত দিয়েছেন।

রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ), এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, সেনাবাহিনী, রিহ্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

আলোচনার শুরুতে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, আমরা গতবারের মতো ড্যাপ করতে চাই না। বিতর্কিত হতে চাই না, প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ করতে চাই না। এ কারণেই আমরা সবার মতামত নিয়ে ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি নতুন ড্যাপ করতে চাই। বিদ্যামান ড্যাপে কিছু ভুল-ত্রুটি রয়েছে, এটা সত্য। আমরা সেটা সংশোধনেরও চেষ্টা করেছি। বিদ্যমান ড্যাপ নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটি এবং সচিব কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। কিন্তু নতুন ড্যাপ করতে হবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ জন্যই আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা চাচ্ছি। তবে একতরফাভাবে কিছুই করা হবে না। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে যান, এমন কিছুই ড্যাপে করা হবে না।

রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা বলেছি, সিএস ও আরএস ম্যাপকে প্রাধান্য দিয়ে জলাশয়, খাল, নদী-নালা যেগুলো আছে সেগুলো রক্ষা করে বাস্তবতার আলোকে নতুন ড্যাপ করা হবে। কোনো জলাশয় ভরাট করা যাবে না। একজন খাল দখল করে, নদী দখল করে বাড়িঘর বানিয়ে ফেলবেন তা হবে না। প্রয়োজনে আমরা সেগুলো ভেঙে ফেলব। এক কথায় ওয়াটার লগিং থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে খাল, জলাশয়, নদী রক্ষা করতে হবে। সিএস, আরএস-কে মাথায় রেখে ড্যাপ করতে হবে। বিদ্যমান ড্যাপে দেখা গেছে, অনেক বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে গেছে, জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। নতুন ড্যাপে এমন ভুল কোনোভাবেই করা যাবে না। যদি এমন ভুল ধরা পড়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করা হবে।

বিএলডিএ এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বিদ্যমান ড্যাপ প্রণয়ন করার সময় কাউকে ডাকা হয়নি। কারও মতামত নেওয়া হয়নি। অন্ধকার ঘরে বসে সেটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ কারণে বিদ্যমান ড্যাপের জন্য মানুষ সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ড্যাপ রিভিউর কথা বলার পর মানুষ শান্ত হয়। তিনি বলেন, নতুন ড্যাপ বাস্তবভিত্তিক করতে রাজউক যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আশা করব, রাজউক এবার বাস্তবভিত্তিক ড্যাপ প্রণয়ন করবে। এ জন্য আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আরও বলেন, আগে ঢাকার ৫৮টি খাল উদ্ধার করেন। এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব। সিএস, আরএস-এ যেসব খাল আছে, সেগুলো যেসব প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে সেগুলো সবাই মিলে উদ্ধার করতে হবে। এ জন্য রাজউককে কঠিন হতে হবে। আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আপনারা কাজ শুরু করেন, প্রয়োজনে বিএলডিএ ৫০ কোটি টাকা দেবে। এক্ষেত্রে সিএস রেকর্ডকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, দেশটা আমাদের সবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের এখন উন্নয়ন চলছে দ্রুত গতিতে। সেই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সবাই মিলে দেশের উন্নয়ন করতে হবে, দেশে শিল্পায়ন করতে হবে সমন্বিতভাবে। তাই ড্যাপ করতে হবে বাস্তবসম্মতভাবে। এমন কিছু করা যাবে না যাতে শিল্পায়ন, উন্নয়ন ধ্বংস হয়।

আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, কিছু কিছু মিডিয়া সব সময় দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়, উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়— এমন সংবাদ পরিবেশন করে। এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকলে দেশের উন্নয়ন হবে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের সবার লক্ষ্য উন্নয়ন। আমরা পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন করব। তাই ড্যাপ করার আগে তাড়াহুড়ো না করে পুলিশ, আর্মি, ল্যান্ড ডেভেলপার, এফবিসিসিআইসহ সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে রাজউককে বসতে হবে। মতামত নিতে হবে।

মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ আর্মির জলসিঁড়ি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা শহর আগে সুজলা-সুফলা ছিল। এখন অসুখে আক্রান্ত। আর এই অসুখ সারাতে পারে রাজউক। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে অসুখ সারাতেই হবে। সবার মতামত নিয়ে একটা সুন্দর ড্যাপ করতে হবে। অনেক জায়গায় সমন্বয়ের অভাব আছে। প্ল্যানিং কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রতিনিধি থাকতে হবে। রাজউককে সমন্বয়ের ভূমিকায় থাকতে হবে।

দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) প্রতিনিধি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ব্যবসায়ীরা আবাসন ও শিল্পায়নসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে ড্যাপ প্রণয়নে ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান ড্যাপ প্রণয়নে ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণির মানুষকে উপেক্ষা করায় ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ হয়েছে। এবার নতুন ড্যাপে জনগণের মতামত গ্রহণ করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।  ঢাকা চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রতিনিধি ফজলুল করিম বলেন, নতুন ড্যাপ প্রণয়ন কাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করায় রাজউককে ধন্যবাদ জানাই। আমরা মনে করি, রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত হবে বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে বসে আলাপ-আলোচনা করে মতামত গ্রহণ করা। এভাবে ড্যাপ প্রণয়ন করলে একটি কার্যকর এবং বাস্তবভিত্তিক ড্যাপ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।

বিএলডিএ’র মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন বলেন, যে কোনো সচেতন নাগরিকই চাইবেন পরিকল্পিত নগরী। কেউই অপরিকল্পিত নগরী চান না। আজকে নতুন ড্যাপের প্রি-প্ল্যানিং সভায় যে পেপারস উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে অনেক ভুল-ত্রুটি আছে। এগুলো সংশোধন করতে হবে।  রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রতিনিধি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য বিস্তীর্ণ জলাধার না রেখে মেকানিক্যাল ড্রেনেজ ডিজাইন করে বিদ্যমান পানি নিষ্কাশন সমস্যার সমাধানের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। তাহলে জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশের আবাসন শিল্পসহ জমির বহুমুখী ব্যবহার সহজতর হবে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) জিয়াউল হাসান, রাজউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, পুলিশের প্রতিনিধি প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর