শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঝুঁকিতে লাখো রোহিঙ্গা শিশু

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

ঝুঁকিতে লাখো  রোহিঙ্গা শিশু

থামছেই না রোহিঙ্গা স্রোত। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে তারা। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যেও আছে অনেক শিশু। বাবার সঙ্গে ঝুড়িতে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত এই শিশুটি ঘুমিয়েই পড়ে। উখিয়া থেকে তোলা ছবি —এএফপি

উখিয়া বালুখালীর ২ নম্বর ক্যাম্পে একটি তাঁবুর প্রবেশ পথে বছর তিনেকের এক রুগ্ন শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মিয়ানমারের রাছিদং থেকে আসা জয়নাব বেগম। শিশুটির চোখজোড়া তখন বন্ধ। তবে কণ্ঠের একটি গোঙানির শব্দ কানে লাগছে। কাছে গিয়ে শিশুটির কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়নাব বেগম জবাব দিলেন, “ওর ‘বাতাস’ লেগেছে। তাই কিছু মুখে দিচ্ছে না আজ তিন দিন ধরে। এক পরিচিত মৌলভীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি ঝাড়ফুঁক করে পানিপড়া দিয়েছেন। তাতে কিছু না হওয়ায়  ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়েছেন এবং বলেছেন পুষ্টি খাওয়াইতে। এখন আমি পুষ্টি পাব কই।” এই দুর্দশা শুধু রোহিঙ্গা নারী জয়নাব বেগমের একার নয়। ঝাড়ফুঁক ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত শত শত রোহিঙ্গা মায়ের এই দশা তাদের শিশুদের নিয়ে। এদের একদিকে যেমন রয়েছে অশিক্ষা-কুসংস্কার ও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, অন্যদিকে রয়েছে পুষ্টিকর শিশুখাদ্যের অভাব। তাই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধনের’ শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবারের লাখো শিশু এখনো স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মূলত রোহিঙ্গা শিশুরা গত দুই মাস ধরে তাদের জীবন ধারণের মৌলিক সেবাসমূহ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। প্রতি ৫ জনের একজন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু রয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থার দাবি। অপ্রতুল শৌচাগার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ডায়রিয়া, কাশি, যক্ষ্মার মতো রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সরকার ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক টিকা দেওয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদেন জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চয়তা করা না হলে ঝুঁকিমুক্ত হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তা না হলে হাজারো শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। সরেজমিন ঘুরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে কথা বলে জানা গেছে, প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে শিশুরা, এর পরে রয়েছে নারীরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পলিথিন ও ত্রিপলের ছোট ছোট বদ্ধ কুঠুরিতে বসবাস, মশা-মাছির প্রাদুর্ভাব ও দুর্গন্ধময় আবহাওয়ায় এমনিতেই নাজুক অবস্থা। তার ওপর প্রয়োজনীয় খাদ্যের ঘাটতি ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে রোহিঙ্গা শিশুরা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা এই শিশুদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। ক্ষুধার্ত, দুর্বল এবং রুগ্ন অবস্থায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে এদের। অনেকেই আগে  থেকেই ছিল পুষ্টিহীনতার শিকার। এখানকার ক্যাম্পের বৈরী পরিবেশে থাকতে হচ্ছে বলে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উদ্বাস্তু শিবিরে শিশুদের বর্তমান অবস্থাকে ‘পৃথিবীর নরক’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে ৫৮ শতাংশই শিশু। প্রতি ৫টি রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে ১ জন চরম অপুষ্টির শিকার। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি এই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণের আহ্বানও জানানো হয়েছে। অতিরিক্ত ত্রাণ ছাড়া এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয় বলেও জানায় ইউনিসেফ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি শিশুর প্রতিদিন যে পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন, তার নিয়মিতই ঘাটতি থাকলে এতে একটি সুস্থ শিশুও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার ওপর যদি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খাদ্য ঘাটতি তাহলে শিশুরা সহজেই রোগাক্রান্ত হবে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশুদের বেলায় তাই হচ্ছে।’

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে অবস্থিত বিদেশি সংস্থা পরিচালিত হাসপাতাল মেডিসিন্স সেন্স অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) এর চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই শিশু। এখানে ভর্তি হওয়ার পর সুস্থ হয়ে শিশুগুলো তাদের ক্যাম্পে ফিরে গেলেও কিছুদিন পর আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার কারণ হচ্ছে অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশু ক্যাম্পে পর্যাপ্ত শিশুখাদ্য পায় না। তাই চিকিৎসা দেওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয় বলে দ্রুতই এসব শিশু পুনরায় রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর