শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সামাজিক অবক্ষয়ে সর্বনাশ

বাড্ডায় বাবা-মেয়ে খুনে পরকীয়া

মাহবুব মমতাজী

রাজধানীর বাড্ডায় জোড়া খুনের নেপথ্যে কাজ করেছে আরজিনা আর শাহীনের পরকীয়া। তাদের অবৈধ প্রেমে বাধা হয়ে ওঠায় নৃশংস খুনের শিকার হন আরজিনার স্বামী জামিল শেখ। আরজিনা, প্রেমিক শাহীন ও শাহীনের স্ত্রী মাসুমা—এই তিনজন মিলে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে ঘুমন্ত জামিল শেখকে। বাঁচার জন্য জামিল শেখ অনুনয়-বিনয় করলেও ঘাতকদের মন গলেনি। শব্দ শুনে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তাদের ৯ বছরের শিশু সন্তান নুসরাত জাহান। মেয়েটি তার মায়ের হাতে রক্তমাখা বঁটি দেখে ভয় পায়। পাশেই দাঁড়ানো কাঠের টুকরা হাতে দাঁড়িয়ে শাহীন। ‘আংকেল, আমার বাবাকে মারছেন কেন?’ শাহীনকে এমন প্রশ্ন করেই বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত বাবার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে শিশু নুসরাত। নিষিদ্ধ প্রেমে

এতটাই মত্ত আরজিনা, নিজের শিশু সন্তানকেও রেহাই দিলেন না। তিনি নিজেই নুসরাতের দু-পা চেপে ধরে শাহীনকে বললেন, ‘এটাকেও শেষ করে দাও’। এ কথা বলতেই শাহীন গলা টিপে হত্যা করে নুসরাতকে। পুলিশি জেরার মুখে আরজিনা স্বীকার করেছেন তার নিষিদ্ধ প্রেমের আদ্যোপান্ত। বর্ণনা করেছেন সেই রাতে স্বামী-সন্তানের খুনের কাহিনী। পুলিশ তার বর্ণনা শুনেছে আর অবাক হয়েছে। একজন মা কীভাবে তাদের পুতুলের মতো নিষ্পাপ শিশু সন্তানকে খুন করলেন, তা পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। আরজিনার দেওয়া তথ্য মতে, খুলনা থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রেমিক শাহীন এবং তার স্ত্রী মাসুমাকে। তিনজনকেই পুলিশ পালাক্রমে জেরা করছে। এরা তিনজনই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে শুরু করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, আরজিনা এবং শাহীনের টার্গেট ছিল জামিল শেখ। কিন্তু দেখে চিনে ফেলায় শিশু নুসরাতকে তারা খুন করে। আর এসব পরিকল্পনা করে আরজিনা এবং শাহীন। শাহীনের পুরো নাম শাহীন মল্লিক। বয়ম ২৬। তিনি রং মিস্ত্রি। তার স্ত্রী মাসুমা বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। বাড্ডায় আগে যে বাসায় আরজিনারা থাকতেন সেখান থেকেই শাহীনের সঙ্গে পরিচয়। ছয় মাসের এই পরিচয়ের মধ্যেই তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ প্রেমে। এসব তথ্য আরজিনা পুলিশের কাছে জানিয়েছেন। গতকাল ভোরে খুলনা থেকে শাহীন ও মাসুমাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় পুলিশ। জুমার নামাজের পরপরই তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার জামিলের ভাই শামীম শেখ বাড্ডা থানায় আরজিনা ও শাহীন মল্লিককে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাখাওয়াত হোসেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আশরাফুল কবির জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে খুলনা এলাকায় শাহীন ও তার স্ত্রী মাসুমাকে গ্রেফতার করা হয়। আগে তারা যে বাসার দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকত, সেখানে তৃতীয় তলায় থাকত শাহীনরা। তখনই তাদের মধ্যে প্রেম হয়। আর বাসা বদলের সময় আরজিনাই কৌশলে শাহীনদের সাবলেটে নিয়ে আসে।

গত মাসে বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগে ৩০৬ নম্বর পাঠানবাড়ীতে বাসা ভাড়া নেন  জামিল শেখ। আগে তিনি আরও তিন বাড়ির পূর্বদিকে ভাড়া ছিলেন। তখন আশপাশে রংমিস্ত্রির কাজ করতেন শাহীন। আর তার স্ত্রী মাসুমা বেগম বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন। ছয় মাস আগ থেকে জামিলের আগের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন শাহীন-মাসুমা। তখন থেকেই শাহীনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে আরজিনার। এরপর প্রেম। অল্পদিনেই দুজনের মধ্যে হয় শারীরিক সম্পর্ক। মোবাইলফোনে এই ভিডিও ধারণ করে রাখেন শাহীন। ওই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আরজিনার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। একপর্যায়ে শাহীনের গভীর প্রেমে পড়ে যান আরজিনা। চলতি বছরের জুনের দিকে বেড়ানোর কথা বলে ৫ বছরের ছেলে আলভীকে নিয়ে বাবা-মায়ের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের বলকৈতে চলে যান আরজিনা। এ সময় বাবা জামিলের কাছেই ছিল নুসরাত। জামিলের ভগ্নিপতি মহসিন এ প্রতিবেদককে জানান, আরজিনা বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় তার সব জিনিসপত্র নিয়ে যায়। তখন জামিল তাকে বলে— ‘কেউ বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে এতকিছু কি নিয়ে যায়?’ উত্তরে তিনি জামিলকে বলেছিলেন— বেড়াতে গেলে মেয়ে মানুষের একটু বেশি কাপড়-চোপড় নিতে হয়। বাবার বাড়িতে যাওয়ার কয়েকদিন পর আরজিনা জানান, তিনি আর জামিলের সংসার করবেন না। কিছুদিন পর গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার সাভারে মায়ের কাছে চলে আসেন আরজিনা। এখানে থাকাবস্থায় শাহীনের সঙ্গে তার একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়। মাস দুয়েক আগে মহসিনের মধ্যস্থতায় জামিলের কাছে ফেরেন আরজিনা। পাঠানবাড়ীর তৃতীয় তলায় দুই রুমের নতুন ভাড়া বাসার একটি তার কথা অনুযায়ী শাহীনকে সাবলেট দেন জামিল। এরই মধ্যে আরজিনা-শাহীনের পরকীয়া বিষয়টি টের পান মাসুমা। কিন্তু আরজিনাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না বলে মাসুমাকে সাফ জানিয়ে দেন শাহীন। সব মেনে নিয়ে শাহীনের সঙ্গে সংসার করতে রাজি হয় মাসুমা। তবে জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনার এই ভাষ্যে অসঙ্গতি পেয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পেশায় গাড়িচালক ছিলেন জামিল। সকালে মেয়ে নুসরাতকে বাড্ডা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দিয়ে গুলশানে এক ব্যক্তির গাড়ি চালাতে চলে যেতেন তিনি। একই সময়ে শাহীনের স্ত্রী মাসুমাও অন্যের বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজ করতে যেতেন। এই সুযোগে আরজিনা আর শাহীন মিলিত হতেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরজিনা আরও জানিয়েছেন, তিনি ও শাহীন আরও কাছাকাছি হওয়ার জন্যই জামিলকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব আচরণই স্বাভাবিক রাখেন আরজিনা। বুধবার রাত ১১টার দিকে শুয়ে পড়ার আগে ঘরের থাই-অ্যালুমিনিয়ামের সব জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর নিজেদের ঘরের লোহার দরজা খুলে রেখে জামিলের পাশে ঘুমাতে যান আরজিনা। তখন রাত সাড়ে ১২টা। কাঁথা মুড়িয়ে গভীর ঘুমে জামিল। সেগুন কাঠের এক টুকরো কাঠ শাহীনের হাতে। আর বঁটি ছিল মাসুমার কাছে। চুপিসারে বিছানার কাছাকাছি তারা দুজন। খুব সাবধানে জামিলের পা চেপে ধরেন আরজিনা। শুরু হয় জামিলের মাথায় শাহীন-মাসুমার একের পর এক কোপ। উপর্যুপরি কোপের আঘাতে জেগে জামিল বলেছিলেন, ‘ভাই আমাকে মারছেন কেন?’ তবুও মাথার ওপর চলছিল কোপ। ছটফট করতে করতে নীরব হয়ে গেলেন জামিল। ঠিক তার আগে পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে নুসরাত জেগে ওঠে। দেখে ফেলে তার বাবাকে মারার দৃশ্য। এ সময় শাহীনকে সে বলে ‘আংকেল আমার আব্বুকে মারছেন কেন?’ এই বলে সে কান্না শুরু করে দেয়। জামিলের মৃত্যু নিশ্চিত করার ৩০ মিনিট পর ঘটনা জানা জানির ভয়ে আরজিনা, শাহীন ও মাসুমা মিলে নুসরাতকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। নুসরাতের দুই পা চেপে ধরে আরজিনা। দুই হাত মাসুমা চেপে ধরলে গলা টিপে নুসরাতের মৃত্যু নিশ্চিত করেন শাহীন। পাশে ঘুমে থাকা শিশু আলভী বুঝতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের পর নিজেদের আড়াল করতে ফজরের কিছু সময় আগে খুলনায় পালিয়ে যান শাহীন-মাসুমা দম্পতি। এরপর খুলনার লবণচরা উপজেলার মোহাম্মদনগর গ্রামে বড় ভাই শামীমের বাসা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।  বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, মূলত ঘটনার সাক্ষী না রাখার জন্যই তারা নুসরাতকে মেরে ফেলেছিল। ঘটনার পরই পুলিশ তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ায় এ পর্যন্ত তদন্তে ভালো অগ্রগতি হয়েছে।  কাকরাইলে মা-ছেলে খুনের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পরেই বাড্ডা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বাবা-মেয়ে খুনের খবর। এরপর সেখানে আশপাশের উত্সুক মানুষের ভিড় জমে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা। বাবা জামিল শেখ (৩৫) ও তার মেয়ে নুসরাত জাহানের (৯) লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায় পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনাকে (২৫)। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যার আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা।

সর্বশেষ খবর