শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৬৪

কেরু ডাকাতের হৃদয়হীন প্রেম

মির্জা মেহেদী তমাল

কেরু ডাকাতের হৃদয়হীন প্রেম

সারারাত ঝড় বৃষ্টির পর সকালটা খুব ঝকঝকে। বাসা-বাড়ি থেকে লোকজন বের হতে শুরু করে। নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত সবাই। প্রকৃতির ঝড় বৃষ্টি শেষ হলেও রাজধানীর অদূরে সাভারের জিয়াউর রহমানের জীবনে শুরু হলো নতুন ঝড়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি জানতে পারেন তার দুই সন্তান আর এক ভাগ্নের মৃত্যুর খবর। রাতে খাবার খেয়ে একসঙ্গে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সেই তিনজনের ঘুম আর কখনোই ভাঙেনি। কিন্তু শরীরে তাদের নেই কোনো আঘাতের চিহ্ন। তাহলে কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো, কেউ তা বলতে পারছে না। একসঙ্গে ৩টা লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়ে সাভারে। শত শত মানুষ ছুটতে থাকে ঘটনাস্থলের দিকে। অনেকেই ভাবে, রাতে ঝড় বৃষ্টির সময় বজ পাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ আসে। কিন্তু পুলিশ কিছুই খুঁজে পায় না। হতদরিদ্র দিনমজুর জিয়াউর রহমান থানায় মামলাও করতে যায় না। সাভার থানা পুলিশও এ নিয়ে আর এগোয় না। বজ পাতে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলেই সবাই বিশ্বাস করে। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও কেউ করেনি।

কিন্তু পুলিশের আরেকটি সংস্থার সন্দেহ থেকে যায়। নিজেদের মতো করে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে দুর্ধর্ষ কেরু ডাকাতের এক হৃদয়হীন প্রেম কাহিনী।  কেরু ডাকাতের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজের দুই সন্তানসহ তিনজনকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে পাষণ্ড এক মা। তবে স্বামী জিয়াউর রহমানকেও হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের। রাতের খাবার খাওয়া হয়নি বলে প্রাণ বাঁচে জিয়াউরের।

এর আগে এ ঘটনার পর থেকে মায়ের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হঠাৎ করে নাসরিন বেগম তার বাসা থেকে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে তাকে আটক করতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। ঘটনার দুই মাস পর পুলিশ সাভারের নবীনগর থেকে নাসরিনকে গ্রেফতার করে। পুলিশি জেরায় স্বীকার করে সেই খুনের কাহিনী। যে কারণে হত্যা করা হয় তিন কিশোরকে : জিজ্ঞাসাবাদে নাসরিন আক্তার জানান, সাভারের জয়নাবাড়ী এলাকায় ভাড়া থাকা অবস্থায় প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া কেরু ডাকাতের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। তখন নাসরিন বেগমের সঙ্গে কেরু মানিকের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠলে তার স্বামী জিয়াউর রহমান জানতে পারলে কেরুকে তাড়িয়ে দিলে সে মিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। আর নাসরিন ও তার পরিবার হেমায়েতপুরের প্রান্ত ডেইরি ফার্মে বসবাস শুরু করে। কিন্তু কেরু মানিক ও নাসরিনের অবৈধ সম্পর্ক চলতেই থাকে। তার স্বামীর অবর্তমানে কেরু ডেইরি ফার্মের ওই বাসায় যেত। একদিন নাসরিনের বড় ছেলে জীবন তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এবং কেরু মানিককে তাদের বাসা থেকে বের করে দেয়। এরপর মানিক নাসরিনের সঙ্গে মিলে ছেলেদের ও স্বামী জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে নিজেরা বিয়ে করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার রাতে কেরু মানিক হেমায়েতপুরে যায় এবং মেহমান সেজে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত নিয়ে জিয়াউরের বাসায় আসে এবং নাসরিনের কাছে একটি বিষের শিশি লুকিয়ে রাখতে দেয়। জিয়াউরের সঙ্গে ঘরের বাইরে গিয়ে কেরু সিগারেট খেয়ে আবার ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে এসে নিজে নাসরিনের নিকট থেকে ভাত চেয়ে খায়। পরে আরও ভাত নিয়ে ও বিষের শিশি ফেরত নিয়ে ভাতের সঙ্গে সেই বিষ মেশায়। তখন নাসরিন সাবধানে কাজ করার জন্য পরামর্শ দেয়। কেরু মানিক সেই বিষ মেশানো ভাত খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে পাশের রুমে যায় এবং নাসির, জীবন ও শাহাদতকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। নাসরিন বাইরে থেকে ভাত খাওয়াতে দেখে ঘুমাতে ঘরে চলে যায়। পরদিন তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। নাসরিনের স্বীকারোক্তির পর জিয়াউর রহমান বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় ৩০২/৩৪ ধারায় নাসরিন ও তার প্রেমিক কেরু মানিকের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা (নং-২৫) দায়ের করে। পরে র‌্যাব-৪ কেরু ডাকাতকে আমিনবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে।

সর্বশেষ খবর