মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
চলচ্চিত্র

যৌথ প্রতারণা! যৌথ প্রযোজনা

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

যৌথ প্রতারণা! যৌথ প্রযোজনা

যদিও এখন চারদিকে ‘ডুব’ চলছে। কথা চলছে, পাল্টা কথাও চলছে। ফিল্মমেকার হিসেবে আমাকে নানা জায়গায় এটা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু আজকের লেখাটা ডুব নিয়ে নয়। আজকে লিখতে বসেছি আমাদের সবার সংকট নিয়ে।

এর আগেও অনেক লেখায় লিখেছি, বাংলাদেশ এবং ভারতের বাংলা সিনেমার নির্মাতা, দর্শক এবং প্রযোজকদের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত সমাধানের নাম ‘যৌথ- প্রযোজনা’। এর বাইরে সাফটা বলেন আর যাই বলেন, সেখানে যে কোনো এক পক্ষের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঘটনা চক্রে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই বঞ্চিত হতে দেখা গেছে বেশি। আশার কথা হলো, সরকার যৌথ প্রযোজনার ছবিকে সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং এ বিষয়ে নতুন নীতিমালা করতে সচেষ্ট হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। যৌথ প্রযোজনা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, যৌথ প্রতারণা বলা হয়েছে। এখন সময় এসেছে একটা সুন্দর নীতিমালা দ্রুত প্রণয়নের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে অনিশ্চয়তা এবং স্থবিরতা নেমে এসেছে তা দূর করার।

যেহেতু এ নীতিমালার সঙ্গে আমাদের এ প্রজন্ম এবং পরবর্তী প্রজন্মের চলচ্চিত্রকার এবং দর্শকদের ভাগ্য জড়িত, ফলে এটা নিয়ে আমাদের খোলামেলা কথা বলা দরকার। পাশাপাশি সরকারের তরফে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা দরকার। কারণ সিনেমা হলের জন্য প্রতি মাসেই ছবি দরকার। আমরা যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার নামে বিলম্ব, করি দু-চার মাস পর কিন্তু সিনেমা হলগুলো ভুগতে শুরু করবে।

যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা বলতে আমরা আসলে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার কথাই বলছি। যদিও কো-প্রোডাকশন অনেক দেশের সঙ্গে হতে পারে এবং সেসব দেশের সঙ্গে কো-প্রোডাকশনে সমানুপাতিক হারে শিল্পী বা অন্যান্য প্রসঙ্গ অবান্তর। যেমন আজকে আমি রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার একটা ছবি করতে পারি যেটার গল্প, লোকেশন, কলাকুশলী সব বাংলাদেশের হতে পারে। তা নিয়ে রাশিয়া বা বাংলাদেশের তরফে কোনো সমস্যা হওয়া উচিত নয়, হবেও না।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের যৌথ প্রযোজনার ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই সম্পূর্ণ আলাদা জায়গা থেকে দেখা উচিত এবং তা সেরকমভাবেই দেখা হচ্ছে। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার নামে আমাদের থিয়েটার ১০০ শতাংশ রাশিয়ান ছবিতে ভরে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দুই পক্ষেই এ বিষয়ে আশঙ্কা আছে। যে কারণে বাংলাদেশে যেমন যৌথ প্রযোজনাবিরোধী আন্দোলন হয়, তেমনি কলকাতায় গেলে আমাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ‘কলকাতায় যে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে বিরক্তি আছে এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী।’ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের এবং নর্থ-ইস্টের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতির নৈকট্য আমাদের সামনে একটা কমন সিনেমার বাজার তৈরি করার দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন এ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারি কেবল খোলা মন এবং ইনসাফের মানসিকতা নিয়ে আগালেই। মনে রাখতে হবে, এটা শুধু সিনেমার বাজার তৈরিতে সাহায্য করবে তা নয়, এই দুই অঞ্চলের মানুষের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আস্থা বাড়াতেও সাহায্য করবে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যা কিছু আমাদের আলাদা করেছিল ব্রিটিশের কলমের খোঁচায়, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু আমাদের মধ্যে আছে, যা আমাদের একে অপরকে ভালোবাসাতে এবং শ্রদ্ধা করাতে পারে। এখন কোন মৌল চেতনার ভিত্তিতে এই যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে। সে ফ একটাই হওয়া উচিত এটার মূল চেতনা : দেশীয় গল্প, কলাকুশলী, পরিচালক এবং সর্বোপরি সিনেমার স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে নীতিমালায় আমরা এমন কিছু বিষয় যেন অহেতুক না ঢুকিয়ে ফেলি যেটা ছবি নির্মাণ প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ এবং জটিল করে তুলতে পারে।

দু-একটা উদাহরণ দিই। আমাদের একটা নিয়ম আছে, শিল্পী, কলাকুশলী এবং পরিচালক দুই দেশ থেকেই সমানভাবে নিতে হবে। এখন যারা সিনেমা শিল্পের ব্যাপারে সামান্য ধারণাও রাখেন তারা জানেন সিনেমায় পরিচালক অনেকটা একেশ্বরবাদী চরিত্রের মতো। সেখানে এক ঘর মে দো পীর গোটা ব্যাপারটাকে কেবল জটিলই নয়, ব্যাপক কাইজাময় করে তুলতে পারে। সিনেমা পরিচালকের ব্যক্তিগত স্বপ্নের ফসল, যেমন কবিতা কবির ব্যক্তিগত স্বপ্নের ফসল। বেশির ভাগ পরিচালকই এ স্বপ্নের ভাগীদার অন্য কাউকে করতে চাইবেন না। ফলে তখনই আমরা সুযোগ করে দিই একটা বেআইনি কাজের। অর্থাৎ একটা নামকাওয়াস্তে পরিচালকের নাম জুড়ে দেওয়া হয় এই দেশ থেকে। আমি মনে করি এই অদ্ভুত নিয়মটাই তুলে দেওয়া উচিত। কলাকুশলী সমানুপাতিক হারে নিক, কিন্তু পরিচালক দুজন রাখার বাধ্যতামূলক নিয়ম তুলে দেওয়া উচিত। জগতে কোয়েন ব্রাদার্স বা দারদেন ব্রাদার্স ঝাঁকে ঝাঁকে আসে না। আরেকটা বিষয় আছে এখানে, যেটা বেশ রিপিটেটিভ। আপনি যৌথ প্রযোজনায় একটা ছবি করতে চান। সেটার স্ক্রিপ্ট জমা দিলেন। পাণ্ডুলিপি কমিটি সেটা পড়ে অনুমোদন দিল। তারপর ছবি বানালেন। সেই ছবি প্রিভিউ কমিটি দেখে পাস করল। এবার আপনাকে আবার যেতে হবে সেন্সর বোর্ডের কাছে। সেই বোর্ড আরেকবার দেখে অনুমোদন দেবে। যদি সেন্সর বোর্ড ছবি দেখে এর গল্প এবং অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার রাখে তাহলে সেটা আগে দুবার স্ক্রিপ্ট রিডার্স প্যানেল এবং প্রিভিউ কমিটি দিয়ে পরীক্ষা করানোর মানে কী? যেহেতু সেন্সর বোর্ড রয়েছে দেখার জন্য যে, এর মাঝে কোনো ধর্মের প্রতি অবমাননা, অশ্লীলতা, সহিংসতা বা রাষ্ট্রবিরোধী কিছু আছে কিনা, তাহলে সেটা আগে দুবার পরীক্ষা করানোর কী কারণ থাকতে পারে আমি বুঝতে পারি না। আমার কথা স্পষ্ট, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক, তবে সেটা যত কম কালক্ষেপণে করা যায়। তারপর আরও অনেক ছোট ছোট প্র্যাকটিকাল ব্যাপার আছে যেটা প্রযোজকরা ধরে ধরে বলতে পারবে। দয়া করে তাদের সঙ্গে বসে নীতিমালাটা দ্রুত করে ফেলেন। বর্তমান সরকার চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াস। আমাদের ফিল্ম মেকাররাও চেষ্টা করছেন, দর্শকরাও পাশে দাঁড়াচ্ছে। এখন আমাদের অভিভাবক হিসেবে মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের চাওয়া— এই নীতিমালা দ্রুত হোক এবং প্রতিনিধিত্বশীল হোক।

সর্বশেষ খবর