রংপুরে ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় ইন্ধনদাতা চারজনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এরা হলেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা সভাপতি ইনামুল হক মাজেদী, রংপুর সদর উপজেলা বিএনপির সদস্য মাসুদ রানা, সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও শলেয়াশাহ জামে মসজিদের ইমাম সিরাজুল ইসলাম এবং খলেয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্য মোস্তাইন বিল্লাহ। এদের মধ্যে সিরাজুল ইসলামকে শুক্রবার রাতে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আরও ৫২ জনকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে
সাংবাদিকদের জানান, হামলার আগে শলেয়াশাহ এলাকায় মানববন্ধন চলাকালে ইনামুল হক মাজেদী, মাসুদ রানা, সিরাজুল ইসলাম ও মোস্তাইন বিল্লাহ উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। পরে তাদের নেতৃত্বে জামায়াত-শিবির এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় আটক ৫৩ জন এবং যারা আহত হয়েছেন তারা সবাই স্থানীয় পর্যায়ের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী বলে দাবি করেন এসপি মিজানুর। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। টিটু রায় ১০ বছর ধরে এলাকায় থাকেন না। তিনি লেখাপড়াও জানেন না। ফেসবুকে তার দেওয়া ধর্ম অবমাননার স্ট্যাটাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। এলাকায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়। ইন্ধনদাতাদের মধ্যে একজনকে আটক করা হয়েছে। অন্যদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। তারা পলাতক। এদিকে এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে। গঙ্গাচড়া থানায় করা মামলার বাদী হয়েছেন এসআই রেজাউল করিম এবং কোতোয়ালি থানায় করা মামলার বাদী এসআই রফিকুল ইসলাম। দুটি মামলায় দুই হাজারের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে। কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় ইনামুল হক মাজেদী, মাসুদ রানা, সিরাজুল ইসলাম ও মোস্তাইন বিল্লাহকে প্রধান আসামি দেখানো হয়েছে বলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম জানিয়েছেন। অন্যদিকে গতকাল সদর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে তিন হাজার করে টাকা ও দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন প্রদান করা হয়। ঘরবাড়ি নির্মাণে সব খরচ সদর উপজেলা প্রশাসন বহন করবে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে পাঁচ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও হরিদেবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেন। হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডািআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য যারা হিন্দু পরিবারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। লুটপাট : হামলা ও অগ্নিসংযোগের সময় ঠাকুরপাড়ার নয়টি পরিবারের ১১টি গরু, দুটি ছাগল, নগদ টাকা এবং ধান-চাল লুট হয়েছে বলে দাবি করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। সুধীর রায় অভিযোগ করে বলেন, ‘হামলাকারীদের বেশির ভাগের মাথায় টুপি আছিল। তারা নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়া আমার বাড়িত আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার ছয়টা ঘর পুড়ি ছাই হয়া যায়। হামলাকারীরা তিনটা গরু লুট করি নিয়া যায়।’ দীনেশ রায় অভিযোগ করে বলেন, ‘হামলাকারীরা আমার একটা গরু, দুইটা ছাগল, নগদ ২০ হাজার টাকা ও এক বস্তা চাউল লুট করি নিয়া যায়। বাড়ির হরিসভা মন্দিরটাও ভাঙচুর করে তারা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় হরিসভা মন্দিরে পূজা করতাম। সেটা ভাঙচুর করায় পূজা করা বন্ধ হয়া গেইচে।’খোলা আকাশের নিচে ক্ষতিগ্রস্তরা : হামলা ও অগ্নিসংযোগে সবকিছু হারানোর পর ক্ষতিগ্রস্ত নয়টি পরিবারের ২৫ জন সদস্য খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। গতকাল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিন ও টাকা প্রদান করা হলেও বিকাল পর্যন্ত নতুন করে কেউ ঘর নির্মাণ করতে পারেনি। কৌশল্লা রানী বলেন, ‘গত রাইতে গাছের নিচে রাইত কাটাইচি। আইজও তাকে করা নাগবে। ঘর তুলতে তো সমায় নাগবে।’
ঠাকুরপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ আতঙ্ক : হামলার পর ঠাকুরপাড়ায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত নয়টি পরিবারসহ ১০০ পরিবারের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক কাটেনি। ক্ষীরোদ রায় বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর এমন হামলা দেখি নাই। পুলিশ চলি গেইলে ফির হামলা করবে কি না সেই চিন্তায় আছি। শুক্রবার রাইতো ঘুমোব্যার পারি না।’ বৃদ্ধা দুলালী রানী বলেন, ‘হামরা কোনো দোষ করি নাই, ক্যানে হামার বাড়িঘর পুড়ি দেলে?’
বাড়িঘর নির্মাণে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্তরা : ঠাকুরপাড়ায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রশাসনে পক্ষ থেকে টিন ও টাকা পেয়ে তারা বাড়িঘর নির্মাণ করছেন। অমূল্য রায় বলেন, ‘আমার দুটা ঘর পুড়ি ছাই হয় গেইছে। সকালে তিন হাজার টাকা, দুই বান্ডিল টিন পাইচি আর বাঁশ। তাকে দিয়া ঘর তৈয়ার করতেচি। হামলাকারীরা আমার একটা গরু, একটা ছাগল, নগদ এক হাজার টাকা ও দুই মণ ধান লুট করি নিয়ে গেচে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রংপুরে ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হামলাকারীদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। গতকাল রাজধানীর ইস্কাটনের দিলু রোডে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার ১০ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বারবার রংপুর, ফরিদপুর, রামুসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলা হচ্ছে। এটি আলেমদেরই খতিয়ে দেখতে হবে। যারা বিনা কারণে অন্যের বাড়িতে হামলা ও লুটতরাজ করে তারা ইসলামের শত্রু।