রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আঞ্জুমানপাড়ায় আবারও রোহিঙ্গা স্রোত

নৌকায় শাহপরীর দ্বীপেও অনুপ্রবেশ, ভেলায় ভাসছে আরও রোহিঙ্গা

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

আঞ্জুমানপাড়ায় আবারও রোহিঙ্গা স্রোত

ভেলায় চড়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গাদের একটি দল। টেকনাফের সাবরাং নয়াপাড়া বিজিবি ঘাট এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে আবারও ২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গতকাল ভোর থেকে তারা মিয়ানমারের কুয়াংছিদং সীমান্ত হয়ে নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে। এর আগে একই সীমান্ত দিয়ে দুই দফায় অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছিল। এদিকে রুট বদলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়া পাড়া সাগর পয়েন্ট দিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন নয়াপাড়া বিওপির কোম্পানি কমান্ডার মো. আতিকুর রহমান। এ ছাড়া টেকনাফের শামলাপুর, নোয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের হাড়িয়াখালী সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েও তিন শতাধিক রোহিঙ্গা মাছধরার ট্রলার ও ভেলায় চড়ে অনুপ্রবেশ করেছে। সাগর পথে আসা এসব রোহিঙ্গাদের বিজিবি হেফাজতে রেখে মানবিক সহায়তা দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। নাফ নদে ভেলায় চড়ে অনুপ্রবেশের জন্য ভাসছে আরও প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা। এ নিয়ে গত তিন দিনে নৌকায় ও ভেলায় করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন শাহপরীর দ্বীপে দায়িত্বরত পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা। গতকাল আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত ও টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরও তল্লাশি করে প্রাথমিকভাবে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীর বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকদিন পায়ে হেঁটে মিয়ানমারের নাইছাদং ও কুয়াংছিদং, পাদংছা সীমান্তে শুক্রবার রাতে জড়ো হন এসব রোহিঙ্গা। ভোর হতেই আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের সরু নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। নাফ নদ পার হয়েই সে াতের মতো খাল, বিল, জলা, ধানখেত মাড়িয়ে এপারে আঞ্জুমানপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার ধানখেতের আইল ও মাছের ঘোনার বড় বড় ডেইলে অবস্থান নেন রোহিঙ্গারা। বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সীমান্তে এবং সীমান্তের জিরো পয়েন্টেই দিনভর চিৎকার, কান্নাকাটিতে ক্ষুধাকাতর এসব রোহিঙ্গার আকুতিতে ভারি হয় ওঠে এলাকার পরিবেশ। বিকাল থেকে তাদের তল্লাশি করে ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অনুপ্রবেশ করা অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী ও শিশু পানীয় জল এবং খাদ্যের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে এপারে এলেও তাদের শরীর হয়ে পড়েছে দুর্বল। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ত্রাণসামগ্রী গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে। গতকাল আসা রোহিঙ্গারা জানায়, সীমান্তবর্তী মংডু থানার গ্রামগুলোতে আর তেমন রোহিঙ্গা না থাকলেও রাখাইনের বুছিদং ও রাছিদং থানায় এখনো কিছু রোহিঙ্গা রয়েছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা এসব রোহিঙ্গাদেরও নানা কৌশলে নির্যাতন চালিয়ে তাড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। তার ওপর রয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর স্থানীয় মগ-মুরংদের অত্যাচার-অনাচার। এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরেই তারা এখন বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন। দীর্ঘ সময় অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে পায়ে হেঁটে আঞ্জুমানপাড়ায় আসা রোহিঙ্গা মহিলা শামসুন্নাহার বেগম (৩৫) জানান, ছয় দিন আগে বুছিদংয়ের ওয়াছিউল্লাহ পাড়া থেকে স্বামীর সঙ্গে চার সন্তানকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বের হন তিনি। কোলে তার বছর দুয়েকের একশিশু। শিশু কোলে পায়ে হেঁটে অনাহারে অর্ধাহারে শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের আঞ্জুমানপাড়া বিপরীতে মিয়ানমারের কুয়াংছিদং সীমান্তে জড়ো হন। তাদের সঙ্গে ছিল পরিচিত-অপরিচিত আরও হাজার দুয়েক লোক। তার স্বামী শফিকুল ইসলাম বলেন, শেষ পর্যন্ত নিজের দেশে আর থাকা গেল না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগদের নির্যাতনের মুখে এখানে চলে এসেছি। আমরা তিন দিন ধরে না খেয়ে আছি। ওখানে আমাদের কোনো কাজকর্ম নেই, ঘর থেকে বের হওয়ারও সুযোগ নেই। খাদ্যের অভাবে আর থাকতে না পেরে রাতের আঁধারে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এলাম। এদিকে নতুন রুট ব্যবহার করে টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া সাগর পয়েন্ট, নোয়াপাড়া এবং ইনানী বিচ সংলগ্ন শামলাপুর এলাকায়ও রোহিঙ্গা আসা শুরু করেছে। এর আগে সীমান্তবর্তী এসব পয়েন্ট দিয়ে কখনো রোহিঙ্গা আসেনি বলে জানান পুলিশ ও স্থানীয়রা। দালালদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে মাছ ধরার ট্রলারে করে আসা এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পাড়া থেকে এসে দীর্ঘদিন ধরে মংডুর নাইক্যনদিয়ায় অবস্থান করছিল। তাঁবু টাঙিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গত দেড়-দুই মাস ধরে মিয়ানমারের নাইক্যনদিয়ায় এসব রোহিঙ্গা অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। এখানে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান থাকলেও এক-দুইশ করে নৌকা ও ভেলায় চড়ে এপারে আসা শুরু করলে এখন সেখানে ১০-১২ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে বলে জানা গেছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ‘চার শর্ত’ : নির্যাতনের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য করা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকার ‘চার শর্ত’র কথা প্রকাশ করেছে। গত শুক্রবার দেশটির রাজধানী ইয়াঙ্গুনে আয়োজিত ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ অবস্থান তুলে ধরা হয়। খবর : কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারের।  ওই সম্মেলনে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউ কিইয়াও জেয়া শর্তগুলো তুলে ধরেন। চার শর্তের মধ্যে রয়েছে, যে সব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে দীর্ঘদিন বসবাসের প্রমাণপত্র দাখিল করতে পারবেন, স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরতে চাইবেন, পরিবারের কেউ এ দিকে রয়েছেন তেমন প্রমাণ দেখাতে পারবেন এবং বাংলাদেশে জন্মানো শিশুগুলোর বাবা-মা উভয়েই মিয়ানমারের স্থায়ী বাসিন্দা- তা প্রমাণিত হতে হবে। তবেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন কাটানো ১০ লাখ রোহিঙ্গা ফেরতে মিয়ানমারের কূটনীতিক যে শর্তগুলোর কথা বলছেন- তা পূরণ যে দুঃসাধ্য, তা কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির ঘুরে আসা বিদেশি অনেক কূটনীতিকই স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছেন, তাদের কাছে নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের কোনো নথি না থাকাটাই স্বাভাবিক।

কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, ইয়াঙ্গুনের ভারতীয় দূতাবাস এবং মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও বিষয়টি উঠে আসে। এর উত্তরে ইউ কিইয়াও জেয়া বলেন, ‘স্কুলে পড়া, হাসপাতালে চিকিৎসা, চাকরির নথি- এ সবের মতো কিছু প্রমাণ তো  দেখাতেই হবে। না হলে ফেরত নেওয়াটা মুশকিল।’ শরণার্থী সংকটের বিষয়ে কেন এত কড়া শর্ত- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাখাইন প্রদেশের এই সমস্যা কেবল মানবিক বিষয় নয়। নিরাপত্তাও একটা বড় কারণ। রাখাইনে সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়াকে নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন ইউ কিইয়াও জেয়া।

সর্বশেষ খবর