রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৭২

এক খুনের তদন্তে ২৬ খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

এক খুনের তদন্তে ২৬ খুন

রাজধানীর মিরপুরে একের পর এক লাশ পড়ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারীরা গুলি করে ব্যবসায়ীকে হত্যার পর লাপাত্তা। এর কদিন পরই বাঙলা কলেজের ভিতরে আরেক তরুণের লাশ। এসব খুনের আসামিরা ধরা পড়ার আগেই নির্মাণাধীন ভবনে লাশ পড়ে। পুলিশ কোনো খুনের ঘটনারই কিনারা করতে পারছে না। মিরপুরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রভাব পড়ে গোটা রাজধানীতে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ যখন মিরপুরের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে চেকপোস্টে তল্লাশি চালায়, আরেক স্থান থেকে খবর আসে ওয়ার্ড কমিশনারকে গুলি করা হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতি যেন পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২০০৫ সালের পর মিরপুর এমন অশান্ত হয়ে পড়ে। সিরিজ খুনে পুলিশ কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়েও এসব খুনে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে         পারে না। অপরাধীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজবাড়ীর স্বরূপচর গ্রাম থেকে এক তরুণকে গ্রেফতার করে গোয়ালন্দ থানা পুলিশ। গ্রেফতারের পর সে তার পরিচয় নিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। পুলিশ একপর্যায়ে জানতে পারে এই তরুণের নাম। সে মিরপুরের বাবু, নাজমুল হাসান বাবু। আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যাঙ্গা বাবু নামে পরিচিত। রাজধানীর পেশাদার হিটম্যান বা কিলারদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হলো ব্যাঙ্গা বাবু। খুন করা তার নেশা, খুন করা তার পেশা। কখনো জবাই করে, কখনো গুলি করে— দুই ভাবেই সে খুন করতে পারদর্শী। পুলিশ একটি খুনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কাছ থেকে বেরিয়ে আসে মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত খুনের তথ্য। ব্যাঙ্গা বাবুর কাছ থেকে ভয়াবহ সব খুনের ঘটনা জানার পর তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। গোয়েন্দারা তাকে নিবিড়ভাবে জেরা করতে থাকেন। গোয়েন্দাদের জেরার মুখে ব্যাঙ্গা বাবু একে একে ২৬টি খুনের তথ্য ফাঁস করে। ঘটনা শুনে ইন্টারোগেশনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা হতবাক। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্য, এমন ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা মাথার হিটম্যান তার চাকরি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেননি। ভাড়াটে খুনি হিসেবে সে খুনের ঘটনাগুলো ঘটায়। কাউকে গুলি করে, কাউকে জবাই করে, আবার কাউকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করে খোদ রাজধানীতেই এই ব্যাঙ্গা বাবু ফুটবল খেলেছে বলেও স্বীকার করেছে।

পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, একসময় ভালো ফুটবল খেলত এই বাবু। গোলকিপার হিসেবে অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বল ধরত। মিরপুরে তার বন্ধুরা তাকে ব্যাঙের সঙ্গে তুলনা করত। সেই থেকে তার নাম হয় ব্যাঙ্গা বাবু। সূত্র জানায়, একসময় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল এই ব্যাঙ্গা বাবু। কিন্তু পরে সে নিজেই দল গঠন করে চাঁদাবাজি-খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাঙ্গা বাবু শুধু রাজধানীতেই নয়, ভাড়াটে কিলার হিসেবেও সে খুন করেছে বিভিন্ন জেলায়। ব্যাঙ্গা বাবুর সিরিজ খুনের কারণে পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অবশেষে পুলিশের হাতে পাকড়াও হয় এই ব্যাঙ্গা বাবু। স্বস্তি ফিরে আসে পুলিশবাহিনীতে। পাঁচ বছর ধরে এই ব্যাঙ্গা বাবু আটক রয়েছে কারাগারে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাতেম আলীর ছেলে ব্যাঙ্গা বাবু। ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠেছে রাজধানীর মিরপুরে। থাকত শাহ আলী এলাকার সি ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৯৩ সালে তার বাবা মারা যান। তখন থেকে সংসারের হাল ধরে ব্যাঙ্গা বাবু ও তার বড় ভাই। কয়েকটি সেলাই মেশিন কিনে বাসায় বসে জামা তৈরি করে মার্কেটে ও দোকানে বিক্রি করত। ধীরে ধীরে কারখানা গড়ে তোলে। কারখানার ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকেই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তার ওঠাবসা। সন্ত্রাসী বাহিনী আলী গ্রুপ, নান্টু গ্রুপ, ইকবাল গ্রুপসহ আরও একাধিক দলের সন্ত্রাসীর সঙ্গে চলতে থাকে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিক, কর্মী ও বস্তিবাসীর ওপর অন্যায়-জুলুম-নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই কর্মকাণ্ড চালাত। ১৯৯৯ সালে ব্যাঙ্গা বাবুর ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত বাপ্পী ও আকরামের কাছে চাঁদা দাবি করে বসে নান্টু গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। না দিলে মারধর করে। তারা ব্যাঙ্গাকেও ছুরিকাঘাত করে। পরে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। ১৯৯৮-৯৯ সালে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ব্যাঙ্গা বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সারোয়ারকে খুন করার মধ্য দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকায়। এরপর ২০০১ সালে ব্যাঙ্গা মিরপুরের লাল্টুকে হত্যা করে। একই বছর সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র রিংকুকে কলেজ মাঠে খুন করে গলা কেটে মাথা নিয়ে যায় ব্যাঙ্গা। খুনের নেশা পেয়ে বসে ব্যাঙ্গা বাবুকে। ওই বছর বাঙলা কলেজের জিএস ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করে। সেগুনবাগিচার নবাব আলীকেও একই কায়দায় খুন করে। এরপর একে একে খুন করে ছাত্রদল নেতা বিপ্লব, মিরপুরের সাবেক কমিশনার তৈয়েবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগ নেতা মাহবুব, প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ, মিরপুর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিটুর ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা মামুন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শওকত হোসেন মিস্টার, মিরপুর ১ নম্বরের মাসুদ ওরফে গোড়া মাসুদকে। এসব সিরিজ খুনের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। শাহাদাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে থাকে সে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর