রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
সিপিডি সংলাপে পররাষ্ট্র সচিব

রোহিঙ্গা ফেরাতে চুক্তির প্রস্তুতি চূড়ান্ত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সংকট সমাধানের চেষ্টার বাইরে মিয়ানমারের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই দ্বিপক্ষীয় একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। খসড়া প্রায় প্রস্তুত। আশা  করছি শিগগির এই চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হবে। চলতি মাসের শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যাবেন মিয়ানমার সফরে। তখন ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন হবে। পরে শিগগির চুক্তি হবে বলে আমরা আশা করছি। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকার বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে পররাষ্ট্র সচিব এসব তথ্য জানান। সিপিডির চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপে অংশ নেন দেশের খ্যাতনামা কূটনীতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, অধ্যাপক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, এনজিও ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি। সংলাপে অংশ নিয়ে তারা পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের মাধ্যমে সরকারের কাছে বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ-পরামর্শ তুলে ধরার পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয়ে জানতে চান। নীতিনির্ধারণী এসব বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব তাদের সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, আজকের রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার এবং এই পরিস্থিতির জন্য তারাই সম্পূর্ণ দায়ী। বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে কোনো দায় নেই। সংকটের একেবারে শুরুতে দীর্ঘ আলোচনা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে মানবিক সাহায্য নয়, জোরালো রাজনৈতিক সমর্থনের প্রত্যাশায় কাজ করছে। সচিব জানান, কিছুদিন ধরে পররাষ্ট্র দফতর থেকে রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহার করা হচ্ছে না। এ নিয়ে অনেকের দ্বিধা তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করছে না, বিপরীতে মিয়ানমারও রাখাইনের এসব বাসিন্দাদের ‘বাঙালি’ বলা থেকে বিরত আছে। এটা একটা কূটনৈতিক আলোচনার অগ্রগতি। একইভাবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে, এটাও আমরা সরাসরি না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাশাপাশি আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা না দেওয়ার বিষয়ে কিছু এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনা আছে। তবে বাংলাদেশ যত দিন সম্ভব শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, এদের দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রাখার একটি কৌশল হিসেবে মিয়ানমারও শরণার্থী ঘোষণার পক্ষে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না।

আরসা সম্পর্কে সচিব বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের মাটিতে কাজ করতে না দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলছে। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জন্য বিরাট বোঝায় পরিণত হয়েছে। সংকটের শুরু থেকেই সমাধানের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাস্তব পরিস্থিতি দেখার জন্য আমরা সবাইকে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করছি। অনেকেই এসেছেন। আমরা বিশ্ববাসীর জোরালো রাজনৈতিক সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। কিন্তু তার পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানবিক প্রতিচ্ছবি ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ সুসম্পর্ক বজায় রেখেই রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ কাজে সফল হব বলেও আমরা প্রত্যাশা করি। সংলাপে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইতিহাসে তৃতীয় নৃশংস জাতিগত নিধন চালিয়েছে। কারণ, এটি পাঞ্জাব, ফিলিস্তিনের পর সবচেয়ে বড় জাতিগত নিধনের ঘটনা। তিনি বলেন, আসলে এত বিপুলসংখ্যক আশ্রয় নেওয়া মানুষকে ফেরত দিয়ে কী করণীয় তার একমাত্র উদাহরণ ভারত একাত্তরে দেখিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং শেষ সময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার কথা না উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, এখন তো আর সেই সমাধানে যাওয়ার উপায় নেই। তার পরও বাংলাদেশ সরকার একই সঙ্গে সফট ও হার্ড ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে সংকট সমাধানে চেষ্টা করছে বলে আমার ধারণা। আসলে উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত সমস্যা সেনাবাহিনীগুলো জিইয়ে রেখেছে। তাদের হাতেই এর চূড়ান্ত সমাধান।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অনেক অর্থনৈতিক জোটে জড়িত। তাই বাংলাদেশ চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। রোহিঙ্গাভিত্তিক উগ্রপন্থি গ্রুপ আরসা (এআরএসএ) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৃষ্টি বলে মন্তব্য করে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, জিহাদ বা মিলিট্যান্সি দুটোই জটিল বিষয়। এখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যখন কোনো জাতি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা পরিচালিত হয়, তখন এটা আর দুই দেশের ইস্যু থাকে না। বিষয়টা তখন আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী (রিফিউজি) বলতে হবে এবং অবশ্যই তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এজন্য চীন, রাশিয়া ও ভারতে শক্তিশালী প্রতিনিধি দল পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি। মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপম চাকমা বলেন, আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, মিয়ানমারে চীনের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। শুধু কাচিনের একটি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টেই ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ রয়েছে। মূলত তাদের বিনিয়োগ বাঁচাতেই এসব দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে না। মিয়ানমারে বাংলাদেশের আরেক সাবেক দূত মোহাম্মদ মুসা বলেন, যেসব দেশ মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এসব দেশে শক্তিশালী প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। তিনিও ভারত, চীন ও রাশিয়ায় প্রতিনিধি দল পাঠানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সংলাপের সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করা সিপিডির ফেলো জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিজের জীবনে দুই দফায় শরণার্থী হওয়ার কথা জানিয়ে এ ধরনের জীবনের কষ্টকর দিকটি তুলে ধরেন। সংলাপে আরও বক্তব্য দেন সাবেক সেনাপ্রধান হারুনুর রশীদ, সাবেক পুলিশপ্রধান নূরুল হুদা, অ্যাকশন এইডের ফারাহ কবীর, বাংলাদেশে বৌদ্ধ জোটের সভাপতি সুকুমার বড়ুয়া, উপজাতিদের অধিকার কর্মী সঞ্জীব দ্রংসহ ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, জার্মান দূতাবাসের কূটনীতিকরা।

সিপিডির ছয় প্রস্তাব : সংলাপের মূল প্রবন্ধে সিপিডির পক্ষ থেকে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে ছয়টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে ‘বিমসটেক’ ও ‘বিসিআইএম’-এর মতো আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ, অতিরিক্ত আঞ্চলিক জোট যেমন ‘আসিয়ান’-এর মতো জোটকে জড়িত করে সমস্যা সমাধানে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সম্পদের জোগানের ব্যবস্থা করা, জেনেভা বৈঠক-পরবর্তী ফলোআপ মিটিং করে অর্থ সংগ্রহে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া এবং বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থার কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু অনুদান হিসেবে সহায়তা সংগ্রহ এবং রোহিঙ্গা ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার কথা বলেছে সিপিডি। মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকার প্রয়োজন। ফলে এটা স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে।

সর্বশেষ খবর