সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মিয়ানমারে সোচ্চার হবেন বিদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা যাননি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মার্কিন সিনেটর বললেন যুদ্ধাপরাধের শামিল

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

সুইডেন, জাপান ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র কমিটির প্রধান গতকাল একসঙ্গে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তারা কথা বলেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। আশ্রিতদের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংস আচরণে হতবিহ্বল অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিয়ে তারা মিয়ানমারের প্রতি জোরালোভাবে দাবি জানাবেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কথা বলবেন এই বর্বরতা নিয়ে।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারে ক্যাম্প ঘুরে আসা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাতে ভিন্ন ভিন্ন বিমানে মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগে তারা সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তবে ঢাকা সফররত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই কে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। রাতে তিনিও মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ও ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেদেরিকো মোঘেরিনি, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনোকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী হেলিকপ্টারে তেজগাঁও বিমান ঘাঁটি থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। বেলা ১১টার দিকে তারা কক্সবাজার পৌঁছে সড়কপথে গিয়ে বেলা ১টার দিকে উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালংসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের সময় তারা নির্যাতনের শিকার কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক অভিবাসন কেন্দ্র আইওএম-এর প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র, জরুরি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন তারা। বিদেশি এই প্রতিনিধিদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শনকালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফেদেরিকো মোঘেরিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের যে বিবরণ এখানে শুনেছি- তা ভয়াবহ। নির্মম পরিস্থিতির শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখানে এই অবস্থায় তারা বেশি দিন থাকতে পারে না। তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে নিতে হবে।’ তিনি বলেন, এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে স্থান দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল বলেন, ‘অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা তাদের দেশ থেকে পালিয়ে আসার যে বিবরণ দিয়েছে- তা অত্যন্ত করুণ। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই স্বদেশে ফেরত যেতে হবে। আমরা এখানে রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে দেখেছি। রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে- সে লক্ষ্যে কাজ করবে জার্মানি।’ রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আসন্ন এশিয়া-ইউরোপ (আসেম) সম্মেলনে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, চার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে এসেছেন ও তারা খুব অবাক হয়েছেন। এর আগে তারা কখনো এত কম জায়গায় এত বেশি মানুষ দেখেননি। তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আসেম সম্মেলনে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সার্বিক সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় বৈঠক : বিকালে ঢাকা ফিরে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি গ্রহণের বিষয়ে জাপানের ভূমিকার জন্য দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনোকে ধন্যবাদ জানান। তারো কোনো প্রতিশ্রুতি দেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে জাপান। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য জাপানের পক্ষ থেকে ১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার ত্রাণ সহায়তার কথাও জানান তিনি। দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর আলোচনার সময় জাপানি ওডিএর অধীনে বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান জাপানের মন্ত্রী। তিনি জানান, ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টোকিও সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রতিশ্রুত ৬ বিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন-এর অধীনে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। ভবিষ্যতে ২০২১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের নেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে জাপান।

মিয়ানমার যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধ করছে : সফর শেষে গতকাল রাতে ঢাকা ত্যাগ করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের একটি প্রতিনিধি দল। আগের দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে আসা এই সিনেটররা এ সময় বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা যুদ্ধাপরাধের শামিল এবং মানবাধিকারের মৌলিক লঙ্ঘন। জেফ ম্যার্কলির নেতৃত্বে সফররত এই সিনেটরদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মার্কিন সিনেটররা বলেন, প্রত্যেক দেশেরই এই অপরাধ ও জাতিগত নিধনের নিন্দা জানানো উচিত। এই সংকটের সমাধান ও উদ্বাস্তুদের নিজ দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সোচ্চার হতে হবে। তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদার সহযোগিতার প্রশংসা করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তারা বলেন, উদ্বাস্তুরা তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি খুবই সন্তুষ্ট। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর নিপীড়নের বর্ণনা দিয়ে জেফ ম্যার্কলি বলেন, তারা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে নির্যাতিতদের কাছ থেকে সরাসরি নিপীড়নের তথ্য সংগ্রহ করেছেন।  সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার আমাদের নিকট প্রতিবেশী। আমরা চাই তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে। তিনি বলেন, শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের পরিচয়পত্র পেয়েছে। মার্কিন সিনেট প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে বলে, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কঠোর পরিশ্রমের স্বাক্ষর। তারা নারীর ক্ষমতায়নেরও প্রশংসা করেন। সিনেটররা জলবায়ু ইস্যু নিয়েও আলোচনা করেন এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকার প্রশংসা করেন। মার্কিন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, কংগ্রেসওম্যান বেট্টি ম্যাক কলাম ও জন সেহকোশি এবং কংগ্রেসম্যান ডেভিড সিসিল্মিন এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শনিবার রাতে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ডা. দীপু মনি ও অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাননি চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী : ঢাকায় দুুই দিনের সফর শেষে গতকাল দুপুরের আগে ঢাকা ত্যাগ করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। একই সময়ে ঢাকা আসা অন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলেও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে যাননি। তবে শনিবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়কে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সহায়তা করবে।’ গতকাল দুপুরে তিনি মিয়ানমার গিয়ে দেশটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট তিন কাইয়াও, ডি-ফ্যাক্টো লিডার অং সান সু চি এবং সেনাবাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইয়াং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অং সান সু চি বলেন, আয়তন ও ক্ষমতার দিক থেকে চীন ও মিয়ানমারের অনেক পার্থক্য। কিন্তু উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চীন ও মিয়ানমার একে অপরের বন্ধু।

মিয়ানমার গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : আগামীকাল থেকে শুরু হতে যাওয়া এশিয়া-ইউরোপ মিটিং এবং মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক উপলক্ষে মিয়ানমার সফরে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। ঢাকা সফর করা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো, ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেদেরিকো মোঘেরিনিকে বিদায় জানানোর পর গতকাল রাত ৯টার কিছু পরে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে বিশেষ বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আজ ও আগামীকাল এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভায় অংশ নেবেন। পরে ২২ ও ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের নেপিদোতে সেদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। আলোচনায় উভয় দেশ সম্মত হলে আগামী ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।

 

সর্বশেষ খবর