শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

৫৭ ধারার আদলেই নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকার বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করার কথা বললেও সেই ধারার বিষয়গুলোই নানাভাবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। যদিও সরকার পক্ষে বলা হচ্ছে, নতুন আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। কিন্তু নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় ৫৭ ধারার বিষয়গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন সাংবাদিক নেতারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার লোকজন। অবশ্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় শাস্তি কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। অবশ্য সাংবাদিক নেতারা বলছেন, আমরা ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ করার এবং এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছি। নতুন যে আইন করা হচ্ছে সেটি সম্পর্কে সাংবাদিক নেতারা কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন কী আইন হচ্ছে সেটা আমরা জানি না। আমরা সব সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছি। এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি। তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে স্পর্শ করে এমন কোনো আইন করতে হলে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে। সাংবাদিক নেতা ও নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কী আমরা এখনো জানি না। তবে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা পুরোপুরি বাতিল করা হবে এটা আমি মনে করি না। নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় হয়তো ৫৭ ধারা ঢুকে যাবে। তিনি বলেন, এটা একটা চালাকি হবে। এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টো সরকারই বিতর্কিত হবে। তিনি বলেন, সরকার যেখানে বলছে ৫৭ ধারা রাখবে না। এটা বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, মত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ। তাই এটি কোনোভাবেই রাখা ঠিক হবে না। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা হচ্ছে জামিন অযোগ্য। এতে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, গত কয়েক মাসে আইসিটি আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা ঠুকে দিয়ে হয়রানির মধ্যে ফেলা হয়েছে। ফলে আইনের এই ধারা মারাত্মক বিতর্কিত হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারি দলের তরফ থেকে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া ও নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। এদিকে বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনে বিতর্কিত ৫৭ ধারা থাকছে না। কিন্তু প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছায় ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। ২৭ ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিসংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারায় আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই অপরাধ যদি দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করেন, তাহলে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য। অবশ্য তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বুধবারের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইনে বিভিন্ন অপরাধের ধরন দেখে বিভিন্ন স্তরের সাজার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৬ কোটি নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ করা হচ্ছে। সুতরাং এখানে সাংবাদিক বলে আলাদা কিছু নেই। সম্প্রচার আইন যখন আসবে, তখন সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হবে।

সর্বশেষ খবর