শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ঢাকায় পোপ ফ্রান্সিস

উদারতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

উদারতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকাল পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু ও ভ্যাটিক্যানের প্রেসিডেন্ট পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে এক ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা (রোহিঙ্গা)। গভীর এই সংকট উত্তরণে বিশ্বের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়ে বিশালসংখ্যক শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে। এটা বাংলাদেশের বড় মনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। উদারতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণও তৈরি করেছে। গতকাল   তিন দিনের সফরে ঢাকা এসে প্রথম দিনে বঙ্গভবনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন পোপ ফ্রান্সিস। এটা বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো পোপের সফর। এর আগে ১৯৮৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর পোপ ষষ্ঠ পল ঢাকায় এক ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করেছিলেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরিপ্রক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চার দিন সে দেশে কাটিয়ে গতকাল বিকালে ঢাকা এসে পৌঁছান পোপ ফ্রান্সিস। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিশেষ ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সাভারের স্মৃতিসৌধে যান তিনি। সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্মৃতিসৌধ থেকে ফিরে পোপ ফ্রান্সিস ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিকে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরে মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান তিনি। সেখানে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন পোপ। মিয়ানমারে পোপের ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ না করা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমালোচনা চললেও গতকাল ঢাকায়ও রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করেননি তিনি। বরং তাদের মিয়ানমারের বিতাড়িত নাগরিক ও শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করেন পোপ ফ্রান্সিস। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, বাংলাদেশ একটি নতুন দেশ। তার পরও পোপদের হৃদয়ে এ দেশের জন্য সব সময়ই বিশেষ স্থান রয়েছে। বাংলাদেশে আসার পথে এই দেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমি মনে করি, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আপনাদের বিশেষ পরিচয়ের ধারক। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য রয়েছে।’ বাংলাদেশের জাতির জনকের কথা উল্লেখ করে পোপ বলেন, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এবং এই আদর্শ সংবিধানে যুক্ত করার কথা বলেছিলেন। তিনি আধুনিক, বহুত্ববাদী এবং অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ এবং জাতি মুক্ত, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারবে, যেখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সমান অধিকার থাকবে। পোপ বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রাখাইন রাজ্য থেকে শরণার্থীদের বিরাট ঢল সাদরে গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশিরা। এতে বাংলাদেশি সমাজের উদারতা ফুটে উঠেছে। শরণার্থীদের জীবন ধারণে প্রয়োজনীয় মৌলিক সহায়তা দিয়েছেন। আর বাংলাদেশিরা এটা করেছেন সারা বিশ্বের সামনে।

পোপ বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে। সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রতি এই সংকট সমাধানে এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানান পোপ। তিনি বলেন, ‘পুরো পরিস্থিতি, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোয় থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু, তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের সাহায্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার ঐকান্তিক আহ্বান এ বিষয়ে দ্রুত ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নৈতিক বাধ্যতা দেয়। কঠিন এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের সমাধানই নয়, বাংলাদেশে দ্রুত মানবিক সহায়তাও দিতে হবে।’

পোপ বলেন, নারী-শিশুসহ হাজারো মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি ভস্মীভূত হতে তারা নিজ চোখে দেখেছে।

আজ সফরের দ্বিতীয় দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮০ হাজার পুণ্যার্থীর উপস্থিতিতে প্রার্থনাসভায় বক্তব্য দেবেন পোপ। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি রয়েছে তার। নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও পোপের সাক্ষাত্সূচি রয়েছে। সেখান থেকে যাবেন প্রধান গির্জা পরিদর্শনে। সেখানে তিনি বিশপ ও জ্যেষ্ঠ যাজকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। শেষে সেখানে শান্তির জন্য আন্তধর্মীয় ও সর্বজনীন ঐক্য বিষয়ে বক্তব্য দেবেন। সফরের তৃতীয় ও শেষ দিন শনিবার সকালে পোপ ফ্রান্সিস রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসার বাসভবন পরিদর্শনে যাবেন। সেখান থেকে হলি রোজারি গির্জার যাজক, ধর্মীয় নারী-পুরুষ এবং অন্যদের সামনে বক্তব্য দেবেন তিনি। এরপর সেখান থেকে প্যারিস কবরস্থান ও প্রাচীন গির্জা ঘুরে দেখবেন। বিকালে নটর ডেম কলেজের তরুণদের সামনে বক্তব্য দেবেন পোপ ফ্রান্সিস। বিকাল পৌনে ৫টায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তুলে দেওয়া হলো পোপের হাতে : পোপ ফ্রান্সিসের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। গতকাল বিকালে ঢাকায় সফররত পোপ ফ্রান্সিস রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনে গেলে তাকে এ উপহার তুলে দেওয়া হয়। পোপ সেখানে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও স্ত্রী পেপি সিদ্দিক। এ সময় জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পোপ। তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর প্রবেশ করেন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। এরপর ঘুরে ঘুরে জাদুঘরের বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখেন এবং সেখানে রাখা পরিদর্শন বইয়ে সই করেন পোপ। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা জাতির জনকের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বই উপহার হিসেবে তুলে দেন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের গুরু পোপ ফ্রান্সিসকে। এ সময় পোপ ফ্রান্সিসও সে দেশের শান্তির প্রতীকসদৃশ একটি বিশেষ উপহার শেখ রেহানার হাতে তুলে দেন। পোপের সঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর