শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ৯৮

হার্টের ছবিতে খুনির পরিচয়

মির্জা মেহেদী তমাল

হার্টের ছবিতে খুনির পরিচয়

খুব ভোরে রাশেদের ঘুম ভাঙে মোবাইল ফোনের শব্দে। ফোনটি দিয়েছে তার গার্মেন্টের কর্মচারী আল আমিন। এত সকালে ফোন পেয়ে একটু বিরক্ত হন রাশেদ। ফ্যাক্টরি থেকে অনেক রাতে ফিরেছেন। ঘুমাতে দেরি হয়েছে। ঘুম কাটেনি তার এখনো। হ্যালো বলতেই আল আমিনের কণ্ঠ, ‘স্যার ফ্যাক্টরির দরজায় তালা। ঢুকতে পারছি না। কী করব?’ এ কথা শুনে ধমক দেয় রাশেদ। বলেন, ‘কী করব মানে? ফাহিম কোথায়? ওকে ফোন দিয়ে গেট খুলতে বল। তালা কে মেরেছে?

দাঁড়াও আমি ফোন দিচ্ছি।’ একথা বলে ফোন কেটে দেন রাশেদ। ফাহিম হচ্ছেন তার শ্যালক। গার্মেন্ট দেখাশোনা করতেন। তাকে ফোনে চেষ্টা করছেন রাশেদ। পাচ্ছেন না। ফোন বন্ধ। ‘গেল কোথায় ছেলেটা? এমন তো কখনো হয়নি। রাতে ফ্যাক্টরিতে রেখে আসলাম। এখন ফোন বন্ধ!’ এমন নানা কিছু ভাবছেন রাশেদ। ফোনে না পেয়ে নিজেই গার্মেন্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। রেডি হয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় তিনি নিজের গার্মেন্টে যান। কর্মচারী আল আমিন দরজার সামনে পায়চারি করছিলেন। রাশেদ অতিরিক্ত চাবি দিয়ে গার্মেন্টের তালা খুলে দেন। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখেন ফাহিম পড়ে আছে। রক্তাক্ত। মাথা গলায় গভীর ক্ষত। শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তাক্ত যখম। ভয় পেয়ে যান রাশেদ। চিৎকার করে ফাহিমকে ডাকাডাকি করতে থাকেন। কিন্তু ফাহিমের কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাশেদ এবার খোঁজ করে কর্মচারী সোহান ওরফে সোহাগকে। এই সোহাগ আর ফাহিমকে আগের রাতে একসঙ্গে রেখে গেছেন তিনি। তাদের সঙ্গে সোহাগের এক আত্মীয় ছিল। এখন ফাহিমকে পাওয়া গেল রক্তাক্ত অবস্থায়। কিন্তু সোহাগ বা তার সেই আত্মীয় নেই। ধরাধরি করে ফাহিমকে গাড়িতে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চলতি বছরের ১৯ মার্চের ঘটনা এটি। ফতুল্লার রুবাইয়া হোসিয়ারি নামক প্রতিষ্ঠানটিতে এই খুনের ঘটনাটি ঘটে। ফতুল্লা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন প্রতিষ্ঠানের মালিক রাশেদ। মামলা নম্বর ৬৩। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে ফতুল্লা থানা পুলিশ আসে। আসে র‌্যাব, গোয়েন্দা আর নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা। প্রত্যেক সংস্থাই নিজের মতো করে তদন্ত করলেও মূল তদন্ত করতে থাকে ফতুল্লা থানা পুলিশ। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে ঘটনার পর থেকে কর্মচারী সোহাগকেও পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের সন্দেহ হয়, তবে কি এটি কোনো ডাকাতির ঘটনা? ফাহিম আর সোহাগ এক সঙ্গে রাতে থাকে। ঘটনার সময়েও এক সঙ্গেই ছিল। তবে তাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল সেই রাতে। নাম ইউসুফ। সে সোহাগের আত্মীয়। গার্মেন্টের মালিক রাশেদ তাদের তিনজনকে এক সঙ্গে রেখে গেছেন। পুলিশ ফ্যাক্টরিতে তল্লাশি চালিয়ে ডাকাতির কোনো আলামত রয়েছে কিনা, তা খুঁজতে থাকে। কিন্তু ডাকাতির কোনো সূত্র পুলিশ খুঁজে পায় না। তাহলে সোহাগ গেল কোথায়? তৃতীয় সেই ব্যক্তি ইউসুফই বা কোথায়? সোহাগই তাহলে খুনি? ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে খুন করতে পারে? এমন সব প্রশ্ন মাথায় রেখে শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। আল আমিনের কাছ থেকে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। জেরার মুখে আল আমিন পুলিশকে বলে, সোহাগ তাকে ভোরে ফোন দিয়েছিল। ফোনে জিজ্ঞাস করেছে, ফাহিম কি এখনো বেঁচে আছে কিনা। এমন তথ্যের পর পুলিশ নিশ্চিত হয়, খুনের সঙ্গে সোহাগ জড়িত। গার্মেন্টের মালিক রাশেদও পুলিশকে জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। তিনিই তা মিটিয়েছেন। কী নিয়ে ঝামেলা, এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ বলে, সোহাগ তার শ্যালক। সে খোঁজখবর নিত। কিন্তু ফাহিমের এমন মালিক সুলভ আচরণ পছন্দ করত না সোহাগ। এমন কথা সোহাগ শ্রমিকদের বলেছে বেশ কয়েক বার। পুলিশ নিশ্চিত হয়, এ কারণেই সোহাগ খুনের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। সোহাগকে গ্রেফতার করলেই মিলবে প্রকৃত কারণ। পুলিশ বলে মালিক রাশেদকে। সোহাগের ঠিকানা চায় পুলিশ রাশেদের কাছে। কিন্তু সোহাগের কোনো ঠিকানা নেই তাদের কাছে। কাজের জন্য এসেছিল ফ্যাক্টরিতে, রাশেদ সোহাগকে কাজে লাগিয়ে দেয়। রাশেদ শুধু জানে সোহাগের বাড়ি গফরগাঁয়ে। এর বেশি কোনো তথ্য তার জানা নেই। মহা মুশকিলে পড়ল পুলিশ। এরপরেও তার খোঁজে পুলিশ কাজ শুরু করে। কিন্তু মামলার অগ্রগতি হয় না। প্রতিদিন ধরনা দেয় রাশেদ পুলিশের কাছে। পুলিশ আসামি গ্রেফতারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। একে একে দিন যায়। মামলার অগ্রগতি হয় না। রাশেদ এলাকায় নানা ধরনের কথা শুনতে পায়। পুলিশ ইচ্ছা করলেই পারে। কিন্তু তারা গরজ দিচ্ছে না। এমন কথাবার্তায় হতাশ হন রাশেদ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর একটি ইউনিট রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শম্পা ইয়াসমীনের নজরে আসে খুনের এই ঘটনাটি। তিনি নিজ উদ্যোগে মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। ঘটনার ১০ দিন পর ফাহিম হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হয় নতুন করে। খুনি চিহ্নিত হলেও লাপাত্তা। তার কোনো ঠায় ঠিকানা নেই পুলিশের কাছে। এটি তারা চ্যালেঞ্জ হিসাবেই গ্রহণ করে। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে পিবিআই কর্মকর্তারা খুনি সম্পর্কে কোনো তথ্য পায়নি। পিবিআই জেলা প্রধান শম্পা ইয়াসমীনের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না যে, শুধু মালিক সুলভ আচরণের জন্য ফাহিমকে খুন করা হবে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে বলে তার সন্দেহ। যদি সেরকম কিছু থাকে, তবে অবশ্যই খুনির ঠিকানা পরিচয় জানা যাবে। এমন নানা কিছু সামনে রেখেই তাদের তদন্ত শুরু হয়। পিবিআই কর্মকর্তারা ওই ফ্যাক্টরির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা ভালো করে দেখতে থাকে সোহাগের থাকার জায়গা। পিবিআই কর্মকর্তা কক্ষের আনাচে কানাচে খুঁজতে থাকে, কোনো সূত্র পাওয়া যায় কিনা। নাহ, তেমন কোনো সূত্রই মিলল না। হঠাৎ এক কর্মকর্তার চোখ আটকে যায় দেয়ালে আঁকা একটি ছবির দিকে। হাতে আঁকা ছবিটি ছিল পানপাতার মতো হার্টের ছবি। হার্টের মাঝখানে ছোট্ট করে লেখা ‘আঁখি’। ছবিটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর পিবিআই কর্মকর্তা আঁখি নামটি নোটবুকে তুলে নেন। এরপর শুরু হয় আঁখি নিয়ে তদন্ত। খোঁজ করতে গিয়ে তারা জানতে পারে ওই ভবনের দোতলায় অবস্থিত অপর একটি গার্মেন্টের শ্রমিক রয়েছে আঁখি নামে। সেই আঁখিকে পুলিশ জেরা করে। আঁখি এসব বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানায়। কিন্তু পিবিআই কর্মকর্তারা তার কথাবার্তায় সন্দেহ করে। কিছু একটা রয়েছে, যা লুকাচ্ছে আঁখি। তাকে ভালোভাবে জেরা করা হলে, ধীরে ধীরে সোহাগ আর ফাহিম সম্পর্কে খুলে বলতে থাকে। আশার  আলো যেন খুঁজে পায় পিবিআই। আঁখি বলে যায়, ‘সোহাগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। আমাকে বিয়ে করবে বলে সে জানায়। আমি তাকে বলেছি, আত্মীয়স্বজন পাঠাও। আমি রাজি আছি। বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করব না। সোহাগ তার বাবাকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কথাবার্তা এগোয়নি। আমাদের সম্পর্ক চলতে থাকে। মালিকের শ্যালক ফাহিম বিষয়টি জানার পরও তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। আমারও ভালো লাগত তাকে। ফাহিম সবার সামনে আমাকে নিয়ে সোহাগকে নানা কথাবার্তা বলত। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদও হয়েছে।’ সোহাগের ঠিকানা জানা আছে কিনা তা জানতে চায় পুলিশ। আঁখি একটি ফোন নম্বর দেয়। ওই ফোন নম্বর দিয়েই সোহাগের বাবা কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে। পুলিশ সেই নম্বরের কল লিস্ট বের করে। দেখতে পান তারা, সোহাগের বাবা পঞ্চগড়ে কথা বলেছে অসংখ্যবার। পুলিশের টার্গেট তখন গফরগাঁও আর পঞ্চগড়। পিবিআই পঞ্চগড় আর গফরগাঁয়ে সোর্স নিয়োগ করে। কিন্তু তার অবস্থান জানতে পারছে না। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে দুই মাস। পুলিশ জানতে পারে, খুন করে গিয়েই সোহাগ বিয়ে করেছে পঞ্চগড়ে। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাক করে সোহাগের বাবাকে খুঁজে পায় গফরগাঁয়ে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পঞ্চগড়ের ঠিকানা খুঁজে পায়। পঞ্চগড়ে পিবিআই পুলিশের একটি দল হাজির হয় সোহাগের শ্বশুর বাড়িতে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু সংবাদ পেয়ে পালিয়ে যায় সোহাগ। পুলিশ জানতে পারে, সোহাগ তখন গফরগাঁয়ে। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই গ্রেফতার করতে পারছে না। অবশেষে পিবিআই কর্মকর্তারা সোর্সের মাধ্যমে সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয়। ওই সোর্স সোহাগকে জানায়, তারা একটি বাসায় ডাকাতি করতে যাবে। এ নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। সোহাগের বাড়ির পাশের একটি মাঠে যেন চলে আসে। আসলে অনেক লাভ হবে। সোহাগ প্রলভনে পড়ে চলতি বছরের ২৯ জুলাই রাতে সেই মাঠে যায়। সেখানে আগে থেকে ওতপেতে ছিল পুলিশ। সোহাগ আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাকে পাকড়াও করে। চার মাসের মধ্যে পিবিআই কর্মকর্তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা কৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনি সোহাগকে গ্রেফতার করে। সোহাগ পুলিশকে বলে, ‘সেই রাতে আঁখিকে নিয়েই ফাহিমের সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধে। এক পর্যায়ে আমার আত্মীয় ইউসুফসহ ফাহিমকে জাপটে ধরে ফেলি। একটি কাঁচি তার মাথা ও গলায় ঢুকিয়ে দেই। এরপর ডাসা দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ফেলে আসি। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সোহাগ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর নারায়ণগঞ্জ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শম্পা ইয়াসমীন বলেন, খুন করে কেউ পালিয়ে থাকতে পারে না। খুনিকে ধরা পড়তেই হয়। পিবিআইর প্রতিটি সদস্য আন্তরিকভাবে কাজটি করেছে বলেই খুনি গ্রেফতার ও খুনের মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে।

সর্বশেষ খবর