শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারের আত্মতুষ্টি কুরে কুরে খাচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতি

অর্থনৈতিক সমিতির সম্মেলনে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নৈতিক অর্থনীতি সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে ব্যক্তি, উদ্যোক্তা ও সমাজের সবাই মিলে সংবিধান মানলে অর্থনীতির নৈতিক দিকগুলো মজবুত হবে। তবে গণতন্ত্রের গভীরায়ণের সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন, ধর্মঘট ও বিক্ষোভ হবে। এসব প্রদর্শনের জন্য জনগণের পথ খোলা রাখতে হবে। অর্থনীবিদদের অভিযোগ, সরকারের নীতিনির্ধারকদের আত্মতুষ্টি আর বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতি সমাজ ও অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ আত্মতুষ্টি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সর্বত্র বিদ্যমান। গতকাল রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে (আইডিইবি)

অর্থনীতিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের আটটি সেমিনারে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও লেখকরা বিভিন্ন ইস্যুতে লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন। পরে হয় মুক্ত আলোচনা। এমন কয়েকটি সেমিনারে

অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন ইস্যুতে গণভোট ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে বলেছেন, দিনবদলের সনদ থেকে অনেক দূরে আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে শিক্ষা এখন করপোরেট সংস্কৃতি। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ ক্ষমতার ভারসাম্য দরকার। করপোরেট ওয়ার্ল্ডে নৈতিক সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলেও মনে করেন তাদের কেউ কেউ। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নীতিনির্ধারকদের আত্মতুষ্টি আর বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতি সমাজ ও অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের বলা হয়, সবকিছু ভালো চলছে। অনেক কাজ করা হয়েছে। আর কিছু করা দরকার নেই। এ কথা শুনে তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। আর যারা বাস্তবায়নকারী তারা কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার পর গাফিলতি শুরু করেন। এ আত্মতুষ্টি ও গাফিলতি সমাজে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সর্বত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘সংবিধানে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি হতে হবে সাম্যভিত্তিক। গ্রাম-শহরে, নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য আনা যাবে না। সমাজ, ব্যক্তি, উদ্যোক্তা সবাই মিলে যদি এই সংবিধানটা মানি, তাহলে আমাদের অর্থনীতির নৈতিক দিকগুলো মজবুত হবে এবং আগামী দিনে চমৎকার সোনার বাংলাদেশ পাব।’ সাবেক এই গভর্নর বলেন, মুদ্রানীতির আলোকে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ। এবার চালের দাম বাড়ায় বড় ক্ষতি হয়েছে গরিব মানুষের। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করা বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ। এটা না করলে নৈতিকতা ব্যাহত হবে। নারী ও ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার স্বার্থও দেখতে হবে। দেশে এখনো অর্থনীতির ৯০ শতাংশ লেনদেন হয় ক্যাশভিত্তিক। তবে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান বাংলাদেশে তারা সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ, এমন দাবি করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়, অনৈতিক রাজনীতিই হলো দুর্নীতির মূল উৎস। যদিও অযোগ্য অর্থনৈতিক নীতির কারণে সুযোগ এলেই মানুষ বার বার সরকার বদল করেছে, অথচ শাসনব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে মিন্টু নির্ধারিত বক্তা থাকলেও তিনি না আসায় তার লিখিত প্রবন্ধ উপস্থিত সবার কাছে সরবরাহ করেন আয়োজকরা। প্রবন্ধে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ব্যবসায়ী-রাজনীতিক আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সরকারগুলো আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। তারা স্বৈরাচারী আদলে দেশ চালাচ্ছে। এই ব্যবসায়ীর মতে, দেশে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হলো সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলে রয়েছে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় রাজনৈতিক অপরাধীদের চক্র। আর এই অপরাধী চক্র তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। অনৈতিক রাজনীতিই দুর্নীতির মূল উৎস। তার মতে, একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ধনী বা গরিব হোক, সেখানে অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটো অঙ্গ থাকবেই। কারণ অর্থনীতির মাধ্যমে রাজনীতি বিকশিত হয় আর রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার বিশ্বাস, কোনো বাজার-আদর্শই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে বিকশিত হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের জোসেফ করবেল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক হায়দার আলী খান তার ‘সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, মতপার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থানে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দল ও মতকে প্রকাশ করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশে গণতন্ত্রকে গভীরতম করতে হলে বেশকিছু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শর্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাড়া-মহল্লা থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গণতন্ত্রের গভীরায়ণের সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হলে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই ক্ষুধামুক্ত বলতে কি শুধু পেট ভরে খাওয়াকে বোঝানো হবে, নাকি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাবার থাকবে। মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে সম্পদের বণ্টন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ‘মহাজোট সরকারের আমলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও আদর্শ অবস্থা থেকে এখনো অনেক দূরে আছে।’ তার মতে, দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা আমলাতন্ত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারিরও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। সিলেট ক্যাডেট কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ জসীম উদদীন তার প্রবন্ধে শিক্ষাব্যবস্থার অনিয়ম ও প্রশ্নফাঁসের বিষয় তুলে ধরে বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় এখন করপোরেট সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সব স্তরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান করপোরেট আদলে পরিচালিত হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। আর কতিপয় মুনাফালোভী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিকে লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে রাষ্ট্রকাঠামো। মুনাফালোভী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। অর্থনীতি সমিতির সদস্য ও শিক্ষক জহিরুল ইসলাম সিকদার তার ‘দূষণ অর্থনীতি ও নৈতিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতার কারণে পরিবেশ নিয়ে কম ভাবা হচ্ছে। সরকার এসব বিষয়ে কমই মাথা ঘামাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর