বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
২০১৭ ফিরে দেখা

নারী সহিংসতা আতঙ্কের বছর

জিন্নাতুন নূর

নারী ও শিশুর নিরাপত্তা ২০১৭ সালে দারুণভাবে ব্যাহত হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরটি ছিল নারী ও শিশু উভয়ের জন্য আতঙ্কের, এটি ছিল তাদের জন্য সহিংসতার একটি বছর। কারণ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ বছর যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়। এমনকি এ বছর অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশেষ করে শিশুদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল নাজুক। দেখা যায় যে, পিটিয়ে বা নৃশংস কায়দায় শিশু হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা চলতি বছরেও আলোচনার জন্ম দেয়।

আতঙ্কের নাম ধর্ষণ : এ বছর নারী, তরুণী, কিশোরী ও কন্যাশিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল উদ্বেগজনক পর্যায়ে। সব বয়সী নারী ও কন্যাশিশুর যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের বিষয়টি ছিল গণমাধ্যমের আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে চলতি বছর ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৩৩৯ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। অথচ ২০১৬ সালের ১২ মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৪১। এ বছর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৮ জনকে। আর গণধর্ষণের শিকার হয় মোট ১০১ জন নারী ও শিশু। আর গত বছর গণধর্ষণের শিকার হয় ৭৭ জন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাতে নারীদের পক্ষে একা চলাফেরা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আলোচিত বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অভিজাত এলাকা বনানীর রেইনট্রি হোটেলে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনা, টাঙ্গাইলের মধুপুরে একটি চলন্ত বাসে বহুজাতিক কোম্পানির এক তরুণী কর্মীকে গণধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থাকে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের ‘আউটকাম’ হিসেবে মনে করছেন। এমনকি ধর্ষণের ফাঁদ হিসেবে এ বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দুর্বৃত্ত ভিন্ন পথ গ্রহণ করে। তারা মোবাইলে কিশোরী ও তরুণীদের সঙ্গে খুব দ্রুত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে পাতছে ধর্ষণের ফাঁদ। এজন্য দুর্বৃত্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকও ব্যবহার করে। উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের প্রধান ডিএমপির ডেপুটি কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন এটি নিশ্চিত করেন যে, ফেসবুক ও মোবাইলের অপব্যবহারের কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন মহামারী রূপ নিচ্ছে।

অগ্রগতি নেই অ্যাসিড-সন্ত্রাসে : অ্যাসিড সারভাইবাল ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, সংখ্যাগত দিক দিয়ে গত বছরের সঙ্গে চলতি বছরের অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনায় খুব বেশি পার্থক্য নেই। ২০১৬ সালে সারা দেশে যেখানে ৪৪টি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে এবং এর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হন মোট ৫০ জন। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত দেশে মোট আসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে ৩৮টি। এর মধ্যে অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হন মোট ৪৭ জন। অর্থাৎ বাংলাদেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা অতীতের চেয়ে কমে এলেও এটি থামানো যাচ্ছে না। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে উল্লাস নামের দুর্বৃত্ত। এতে সেই ছাত্রীর মুখমণ্ডল ঝলসে যায় এমনকি তার মায়ের শরীরও অ্যাসিডে আংশিক ঝলসে যায়।

থামেনি শিশুদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড : চলতি বছরও শিশুদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। এ বছর সেপ্টেম্বরে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে চুরির অভিযোগে সাগর নামের এক শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া অক্টোবরে নরসিংদীর শিবপুরে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে আজিজা নামের আরেক কিশোরীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, ‘শিশুদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো অবমূল্যায়নের জায়গা থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে না পারলে এবং পরিস্থিতি যদি আমাদের গ্রাস করে তাহলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’ এ ছাড়া বছরের শেষ দিকে চট্টগ্রামে একসঙ্গে চার নারীকে গণধর্ষণ, বগুড়ায় ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনাগুলো আলোচনা সৃষ্টি করে।

সর্বশেষ খবর