বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

চোখ পাঁচ বড় প্রকল্পে

নির্বাচনের আগে পদ্মা সেতু মেট্রোরেলসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অগ্রাধিকার

মানিক মুনতাসির

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৮ সালের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজিয়েছে সরকার। এ জন্য আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে চলতি বাজেট থেকে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না। বিশেষ করে নতুন কোনো বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে একনেকে পাস হওয়া নতুন বড় প্রকল্পগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। আর নতুন কোনো খাতে করারোপ করা হবে না। তবে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকবে বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই যান চলাচলের জন্য পদ্মা সেতুটি খুলে দিতে চায় সরকার। এই সেতুকে ঘিরে আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। তা হলো পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন। সেতুতে যেদিন থেকে যান চলবে সেদিন থেকেই রেলও চলবে। এই লক্ষ্যেই কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া ঢাকাবাসীকে স্বস্তি দিতে মেট্রোরেলের অন্তত প্রথম অংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষের যেন ভোগান্তি কম হয় এ কথা মাথায় রেখেই সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালি পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর-বনানী অংশও নির্বাচনের আগেই চালু করার চেষ্টায় আছে সরকার। এ লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে চলছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোডের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার, বনানী ওভারপাশ, কুড়িল ফ্লাইওভার, মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার, চট্টগ্রামে আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারসহ একাধিক ফ্লাইওভার, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দুর্ভোগ কমে গিয়ে নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরেছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মহিপালে দেশের প্রথম ৬ লেনের ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজও শেষ হয়েছে। উদ্বোধন ৪ জানুয়ারি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রূপগঞ্জের ভুলতা ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। আগামী জুনে এটি উদ্বোধন হতে পারে। পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পসহ যে ১০টি প্রকল্পকে ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত করা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগেরই কাজ শেষ করতে চায় সরকার। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা ও যানজট নিরসনে যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে সেগুলোও ২০১৮ সালের মধ্যেই শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার যেসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে এসব কাজ নির্বাচনের অন্তত ছয় মাস আগেই শেষ করার তাগিদ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পরিকল্পনা কমিশন। ঢাকার ভিতরে ছোট-বড় সব রাস্তা মেরামত ও সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চায় সরকার। এ জন্য সারা দেশের হাইওয়েগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে গতি আনা হবে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল থেকে রংপুর মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজও হবে এ সময়ে। ঢাকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী কাঁচপুর, গোমতীসহ চারটি সেতুর সম্প্রসারিত কাজ শেষ করা হবে। এসব সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সূত্র মতে, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা সেতু নির্মাণ। যার কাজ নিজস্ব অর্থায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি পিলারের ওপর স্প্যান বসানো হয়েছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে এ প্রকল্পের। এ প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়েই প্রকল্প সমাপ্ত হবে। এ জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্ক ফোর্সের সভায় এসব প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, একমাত্র সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর ছাড়া সবগুলো প্রকল্পের কাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প তদারকি টাস্কফোর্সের সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, এখন পর্যন্ত এসব প্রকল্পের কাজের যে অগ্রগতি হয়েছে তা সন্তোষজনক। আগামী বছরের মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। আর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু : এ প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণ কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশ, এ ছাড়া নদীশাসন কাজ হয়েছে ৩৪ শতাংশ। জাজিরা প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তে এই সংযোগ সড়কের কাজ হয়েছে ১০০ ভাগ। সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজ ১০০ ভাগ এবং প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। একই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন প্রকল্পের কাজ। অন্তত সেতুর মূল অংশে রেল চলবেই একই দিনে। অর্থাৎ যেদিন এ সেতুতে গাড়ি চলবে, সেদিন রেলও চলবে। তবে এই সেতুর দুই প্রান্তের রেল লাইনের কাজে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে বলে জানা গেছে।

মেট্রোরেল : বর্তমান সরকারের নেওয়া আরেকটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ মেট্রোরেল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের কাজও চলছে বিরামহীন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। আগামী বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ গুছিয়ে আনতে চায় সরকার। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে প্রকল্পটির একাংশ উদ্বোধন করা যায় কিনা—সে চিন্তা করছে সরকার। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২ হাজার ১৬২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইন স্থাপন করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে আগারগাঁও থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, মতিঝিল পর্যন্ত লাইন স্থাপন করা হবে। সূত্র জানায়, এর বাইরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ১০টি প্রকল্পের কাজে আগামী বছর দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে চায় সরকার। এ ছাড়া সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট সংস্কার করা হবে। চরাঞ্চল, নদী ভাঙন এলাকা ও এ বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় নতুন কিছু ব্রিজ ও কালভার্ট ও বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুরনো বাঁধের সংস্কারের পাশাপাশি নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

এ ছাড়া ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে আগামী বছর। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কৃষি ও শিল্পখাতকে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছর ৭ দশমিত ২৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর