বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিচারক শৃঙ্খলাবিধি গ্রহণ করে আপিল বিভাগ

ক্ষমতা খর্ব হয়নি সুপ্রিম কোর্টের

নিজস্ব প্রতিবেদক

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গেজেট গ্রহণ করে আদালত বলেছে, নিম্ন আদালতের চাকরির শৃঙ্খলা বিধিতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া সরকার কিছুই করতে পারবে না। তবে এ মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট গেজেট গ্রহণ করার পর আমার আর কিছুই বলার থাকে না। এ নিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের অবসান হলো।’ শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের চাকরির শৃঙ্খলার বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর তা জারি হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট আপিল বিভাগের আদেশে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের রাষ্ট্রপতির বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। আমরা তা প্রত্যাহার চাই।’ আদালত বলে, ‘সেটা করা যাবে। আগে গেজেটের বিধিগুলো পড়ুন।’ এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বিধিমালা পড়তে গেলে মাসদার হোসেন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘বিধিমালা চ্যালেঞ্জ করে আমরা রিভিউ আবেদন করব। এ বিষয়ে আমার লিখিত বক্তব্য আছে। সেটা নিষ্পত্তি করুন। নিয়ম অনুযায়ী হাই কোর্ট রুলস তৈরি করবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ করবেন। এরপর গেজেট জারি হবে।’ আদালত বলে, ‘মাসদার হোসেন মামলায়ই আপিল বিভাগ রুলস তৈরি করতে নির্দেশনা দিয়েছিল। সে অনুযায়ী এর আগেও রুলস তৈরি হয়েছে। গেজেট প্রকাশ হয়েছে।’ ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘এই গেজেট নিয়ে কথা বলতে চাই।’ আদালত বলে, ‘অবশ্যই বলবেন। রুলসে কী আছে তা দেখতে চাই। অন্য কিছু থাকলে তা তো যে কোনো সময় পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে। একবার রুলস করলে যে আর পরিবর্তন করা যাবে না তা তো নয়। কিন্তু বলা হচ্ছে, আমরা সব দিয়ে দিয়েছি। কোথায় সব দিয়ে দিয়েছি, তা দেখান। গণমাধ্যমে এ নিয়ে উল্টাপাল্টা লেখা হচ্ছে।’

শুনানিতে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে গেজেট থেকে বিভিন্ন অংশ পড়তে বলে। অ্যাটর্নি জেনারেল বিভিন্ন অংশ পড়েন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়টি আসামাত্রই আদালত বলে, ‘দেখুন, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান রাখা হয়েছে।’ শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলে, ‘দেখুন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ এর জায়গায় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ এর নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। আগে এটি ছিল না। সবখানে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া (কোনো বিষয়ে) অনুসন্ধান করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া সরকার কিছুই করতে পারবে না। অথচ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট সব দিয়ে দিয়েছে! আমরা সব দিয়ে দিয়েছি! ধারা ২৯ পড়ুন। এটা তো আরও মারাত্মক। সেখানে বলা আছে, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ প্রাধান্য পাবে। দুঃখের বিষয় কেউ পড়ে না। এই ধারা না পড়েই আন্দাজে মন্তব্য করা হচ্ছে! না পড়েই পত্রিকায় লেখা হয়। তাহলে আমরা পাঁচজন জাজ যে এটা (শৃঙ্খলাবিধি) অ্যাগ্রি করলাম। আমরা কি কিছু বুঝি না? নবিস জাজ? বলা হচ্ছে, আমরা সবকিছু শেষ করে ফেলেছি!’ আদালত বলে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো প্রস্তাব দিলেও সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ না দিলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কিছু করতে পারবে না। কোনো কিছু করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে। অথচ বাইরে বলা হচ্ছে, গেল গেল, সব গেল! আমরা সব দিয়ে দিইনি।’ এ সময় ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট গেজেট গ্রহণ করার পর আমার আর কিছুই বলার থাকে না।’ এরপর আদালত আদেশ দেয়। আদেশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের সুপ্রিমেসি রেখে সরকার অধস্তন আদালতের যে শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি প্রকাশ করেছে, তা গ্রহণ করেছে আপিল বিভাগ। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো চলমান রাখা হয়েছে।’ শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির গেজেট আদালত গ্রহণ করেছে। আদালত এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথককরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দেয়, তাতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা তৈরির নির্দেশনাও ছিল। এরপর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী বলে এর আগে এক শুনানিতে জানান আপিল বিভাগ। পরে ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয়। আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এর আগে শৃঙ্খলা বিধিমালার যে খসড়া সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছিল, গত বছর ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ এবং বিধি নিয়ে ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছিল আপিল বিভাগ। ওই সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস কে সিনহা। শৃঙ্খলাবিধির খসড়া নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে দেশ ত্যাগের পর ১০ নভেম্বর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ১৬ নভেম্বর দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে বৈঠক করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, সেই খসড়া নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে। এরপর ১১ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

 

মাসদার হোসেন মামলা থেকে বাদ কামাল-আমীর : ড. কামাল হোসেন ও এম আমীর-উল ইসলামের বিরুদ্ধে মাসদার হোসেন মামলাটি রাজনীতিকরণের অপচেষ্টার অভিযোগ তুলে মামলাটি পরিচালনা থেকে তাদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধির গেজেট সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করার পর গতকাল অ্যাসোসিয়েশনের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। কামাল ও আমীরসহ ছয়জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এই গেজেটে আপত্তি জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, এটি মাসদার হোসেন মামলার উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থি এবং এতে বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব ফুটে উঠেছে। ওই বিবৃতি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ঢাকায় কর্মরত বিচারকরা গতকাল  বৈঠক করেন। ‘অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্যে এই বিধিমালার বিষয়ে কোনোরূপ অসন্তোষ নেই’ বলা হয় জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিজ্ঞপ্তিতে।

 এতে আরও বলা হয়, ‘শুনানিকালে ব্যারিস্টার আমীরুল (আমীর-উল) ইসলাম অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বার্থবিরোধী বক্তব্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থাপন করায় এবং তার উক্ত বক্তব্য আদালত কর্তৃক গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তার এরূপ নেতিবাচক বক্তব্যে অসন্তেষ প্রকাশ করছে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনকে মাসদার হোসেন মামলা পরিচালনার যে ক্ষমতা (ওকালতনামা) এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যগণ প্রদান করেছিল, তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

সর্বশেষ খবর