শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকে ভাসছে সারা দেশ

২০০ গডফাদার, ১ লাখ ৬৫ হাজার বিক্রেতার নেটওয়ার্ক ♦ মাদক খাতে লেনদেন ৬০ হাজার কোটি টাকা

সাঈদুর রহমান রিমন

সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ, প্রশাসনিক দৌড়ঝাঁপ আর অসংখ্য মামলা-হয়রানির মধ্যেও দেশে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের কেনাবেচাও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। দেশের প্রতিটি সীমান্ত এলাকা থেকে শুরু করে খোদ রাজধানীতেও বসছে মাদকের খোলা হাটবাজার। লুকোচুরি নয়, বরং প্রকাশ্যেই বেচাকেনা চলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্য। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশের পৃথক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালী ২০০ গডফাদারের তত্ত্বাবধানে এক লাখ ৬৫ হাজার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার সমন্বয়ে দেশব্যাপী মাদক-বাণিজ্যের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এ চক্রের সদস্যরা ঘাটে ঘাটে টাকা বিলিয়ে সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও প্রশাসনিক অভিযান পরিচালিত হলেও তা মাদক নেটওয়ার্কে কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। বরং পুলিশের পাঁচ শতাধিক সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের সহস্রাধিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে উল্টো মাদক-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মাদকাসক্তি নিরাময়ের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালের মধ্যে দেশে এক কোটি লোক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, প্রতি বছর শুধু নেশার পেছনেই খরচ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা এই মুহূর্ত থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নেশামুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে দেশজুড়ে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তারা বলেন, অন্যথায় দেশের যাবতীয় অগ্রগতি নেশার আগ্রাসনের কাছে ম্লান হতে বাধ্য। সারা দেশে র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও মাদকের আগ্রাসী থাবা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি কঠোর পদক্ষেপের মধ্যেও মাদক ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সচল রয়েছে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাও। মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে তারা। এসব নিত্যনতুন কৌশলে পাচার হওয়া মাদক ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ইদানীং বাকপ্রতিবন্ধীদের মাধ্যমেও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। এতে ইয়াবাসহ বোবারা ধরা পড়লেও তারা মূল মাদক ব্যবসায়ীর নাম-পরিচয় কিছুই জানাতে পারছে না, দিতে পারছে না স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। অন্যদিকে একশ্রেণির হিজড়া আনা-নেওয়া করছে ফেনসিডিল। এ ছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্টিকার, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের স্টিকার লাগানো গাড়ি ব্যবহার করেও মাদক পাচার করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের অভ্যন্তরীণ ৪৭টি রুটের যানবাহন ও ট্রেনে অবাধে আনা-নেওয়া চললেও খুবই সীমিত পরিমাণ মাদক আটক করতে পারছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর সর্বত্রই মাদক ব্যবসায়ী আর নেশাখোরদের চলছে দাপুটে তত্পরতা। গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রেকর্ডপত্রে নগরীতে ৫৪২টি মাদক স্পট ছিল। এখন সে সংখ্যা বেড়ে হাজারে পৌঁছেছে।

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত গলিয়ে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, আফিম থেকে শুরু করে সব ধরনের নেশাজাত সামগ্রী অবাধে পাচার হয়ে আসে। সেসব স্থানে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী আর প্রশাসনিক শক্তির মিলিত সহায়তায় মাদক ব্যবসায়ীরা অসম্ভব ক্ষমতায় বলীয়ান। সীমান্ত ডিঙিয়ে আনা মাদকদ্রব্য নিরাপদে গুদামজাত করা হয় প্রায় প্রকাশ্যেই। তারপর সেসবের চালান পাঠানো হয় রাজধানীসহ জেলায় জেলায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন জেলায় অপ্রতিরোধ্য রয়েছে এ মাদক সাম্রাজ্য। দেশে সবচেয়ে ক্ষমতাধর মাদক সিন্ডিকেট হচ্ছে কক্সবাজারের ইয়াবা সিন্ডিকেট। সেখানে অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেটের আওতায় হাজার পাঁচেক মানুষ সরাসরি মাদক-বাণিজ্যে জড়িয়ে আছে। তারা মিয়ানমার সীমান্ত গলিয়ে টেকনাফ-উখিয়ায় পাচার করে আনে মরণঘাতী লাখ লাখ ইয়াবা। সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে সেসব ইয়াবা রাজধানীসহ ১৫টি জেলায় সরাসরি সরবরাহ করা হয়। সেখানেও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।

অন্যদিকে ভারত থেকে ফেনসিডিলের পাশাপাশি বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ট্যাবলেট আসছে মুড়ি-মুড়কির মতো। প্রতিদিন ট্রেন, বাস ও ট্রাক ব্যবহার করে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, মাদক ইনজেকশন, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, মদ, বিয়ারসহ ১১ ধরনের নেশাজাত দ্রব্যের পাইকারি চালান ঢাকায় এসে পৌঁছাচ্ছে। মাদকের চালান যাচ্ছে অন্য জেলাগুলোতেও। এ ছাড়া কক্সবাজার-চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে মরণনেশা ইয়াবার চালান যায় বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী উপকূলের ঘাটে ঘাটে। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় মাদক পৌঁছায় নৌপথে। গত কয়েক দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংগৃহীত তথ্যাদি এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশের রেকর্ড ঘেঁটে এসব খবর পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, থানা পর্যায়ে মাদক কেনাবেচা ও সেবনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে গাজীপুরের টঙ্গী থানার নাম। সেখানে প্রতিদিন কোটি টাকার নেশাপণ্য পাইকারি ও খুচরা আকারে কেনাবেচা হয়। পাঁচ শতাধিক পয়েন্টে বসে নেশা সেবনের আসর। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মিলিয়ে এ থানা এলাকায় প্রায় ৬০০ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এদিকে পুলিশের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফলতা দেখিয়েছে কুমিল্লার দেবিদ্বার থানা এলাকা। সেখানে পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্তরের বাসিন্দাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে মাত্র দুই বছরে থানার বেশির ভাগ এলাকা মাদকমুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে বলে জানা গেছে।

মাদকে লেনদেন ৬০ হাজার কোটি টাকা : দেশের ৭০ লাখ মাদকাসক্তকে ঘিরে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের বহুমুখী ধান্দা-বাণিজ্য চলছে। মাদক আমদানি, বেচাকেনা, চোরাচালান, মাদক নিরাময় কেন্দ্রসমূহের বেপরোয়া বাণিজ্য, মাদক প্রতিরোধের নামে আড়াই শতাধিক এনজিওর বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের বছরব্যাপী নানা অভিযান, মামলা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এই বিপুল অঙ্কের টাকার লেনদেন ঘটে থাকে। আইসিডিডিআরবির সমীক্ষায় বলা হয়, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক ব্যবহারজনিত ব্যয় বছরে ৫৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে ৭৫ লাখ মাদকসেবী বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এর সঙ্গে মাদক নিরাময় কেন্দ্র, এনজিও কার্যক্রম ও সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে জানা গেছে। তবে গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির বার্ষিক গড় ব্যয় আড়াই লাখ টাকা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর শুধু ভারত থেকেই অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার মাদক আমদানি হয়ে থাকে। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতিবছর ভারত থেকে শুধু ফেনসিডিলই আসে তিন হাজার ৪৭ কোটি টাকার। দেশজুড়ে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন মাদক বাবদ সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে মিয়ানমারে। প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন চোরাচালান পথে ৩০ লক্ষাধিক পিস ইয়াবা দেশে ঢুকছে বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা গেছে। সে হিসাবে শুধু ইয়াবা বাবদ প্রতিবছর অন্তত মিয়ানমারেই পাচার হয়ে থাকে ১৩ হাজার কোটি টাকা।

মাদকাসক্ত নিরাময়ের নামে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ ওই সব কেন্দ্রের অধিকাংশের বৈধ কোনো অনুমোদন নেই, নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। এসব স্থান থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারার নজিরও নেই। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করে কেউ কেউ সমাজসেবা অধিদফতর, ঢাকা সিটি করপোরেশন বা মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে অনুমোদন নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে মাদক নিরাময়ের নামে এমন ১২ শতাধিক প্রতিষ্ঠান অভিনব বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। ৪ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের একেকটি বদ্ধকক্ষে মাদকাসক্তকে মাসের পর মাস আটক রেখে তার ওপর চালানো হচ্ছে নানা বর্বরতা। এ অমানবিকতার বিল বাবদ একেকজনের পরিবার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৪০-৫০ হাজার টাকা। প্রায়ই এসব কেন্দ্র থেকে হাত-পা বাঁধা, সারা দেহ থেঁতলানো অবস্থায় লাশ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর