শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে মির্জ্জা আজিজুল

বেশ কয়েকটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতিতে

মানিক মুনতাসির

বেশ কয়েকটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতিতে

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি এ খাতের গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় অনেকের মনে সংশয়-সন্দেহ দেখা দিয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার আবারও উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করবে। গত মঙ্গলবার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বিজনেস স্কুলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে কোনো ধরনের চাপ রয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

মির্জ্জা আজিজ : এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৬-তে বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর ২০১৭-তে এই খেলাপি ঋণ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে যোগ হবে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা অবলোপন করা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে নানা রকম দুর্নীতি যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া এবং ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন ব্যাংকিং খাতকে ক্রমশই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রেও সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সামনে জাতীয় নির্বাচন। এজন্য আগামী বছরের বাজেটা কেমন হওয়া উচিত। পাশাপাশি বর্তমান ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে সরকার কতটা সফল হবে বলে আপনি মনে করেন।

মির্জ্জা আজিজ : চলতি অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের আগেই আমি বলেছিলাম এ বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, সরকার উচ্চাভিলাষী বাজেট দিচ্ছে। প্রত্যেক বছরেই বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি হয়। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে বস্তুনিষ্ঠ কারণ নেই। বিশেষ করে কর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাজেটের যে লক্ষ্য সেখান থেকে অনেক দূরে রয়েছে এনবিআর। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন গত বছরের তুলনায় কিছু বেশি হলেও সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের বাজেট বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। যেহেতু এটা নির্বাচনী বছর সে কারণে আমার ধারণা সরকার আরেকটি উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করবে। অর্থাৎ অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অব্যাহতভাবে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খাতে চাপ বাড়ছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কোনো প্রকার চাপ পড়বে কিনা।

মির্জা আজিজ : ডলারের দাম বাড়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, আমদানির প্রবৃদ্ধি রপ্তানির প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের আমদানি হঠাৎ করে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও ব্যয় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। এ জন্যই ডলারের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের ঋণাত্মক মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এই মাত্রা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১৪৮০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অক্টোবরে তা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩১১ মিলিয়র ডলারে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে স্বভাবতই রিজার্ভের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার কতগুলো মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কতটা বাড়বে বলে আপনি মনে করেন।

মির্জ্জা আজিজ : যে মেগা প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরসহ বৃহৎ ১০টি প্রকল্প নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মাধ্যমে দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা যায়। তবে আমাদের দেশের বড় সমস্যা হচ্ছে সব প্রকল্পই বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা। যথা সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারার ফলে প্রকল্পের ব্যয় অনেক মাত্রায় বেড়ে যায়। ফলে দেশ কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার সারা দেশে ১০০  ইকোনমিক  জোন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এসব জোন দেশের অর্থনীতি বিকাশে কতটা ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন। 

মির্জ্জা আজিজ : বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও কল-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে জমির প্রাপ্ততা নিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, যা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। ১০০  ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন করতে পারলে এ সমস্যা লাঘব হবে বলে আশা করা যায়। এক্ষেত্রে কত দিনে ইকোনমিক জোনগুলো বাস্তবায়িত হবে সেটাই দেখার বিষয়। উপরন্তু শুধু জমি পেলেই যে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন এই প্রত্যাশা বাস্তবভিত্তিক নয়। কেননা জমি প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং এনার্জির প্রাপ্ততা নিশ্চিত করতে না পারলে আশানুরূপ বিনিয়োগ অর্জিত হবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : গত অর্থবছর আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। কিন্তু সে হারে কি কর্মসংস্থান বেড়েছে বলে আপনার মনে হয়?

মির্জ্জা আজিজ : গত অর্থবছর ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘোষণা করেছে সরকার। তবে এই সংখ্যাটি প্রশ্নবিদ্ধ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যে প্রাক্কলন করেছিল এবং আমি নিজেও একটি প্রাক্কলন করেছিলাম এর সবগুলোই ৭ শতাংশের নিচে ধারণা করা হয়েছিল। এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের যে সম্পর্ক তা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। ফলে আমাদের জিডিপি বাড়লেও সাধারণ মানুষ সে হারে অর্থনীতির সুফল পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন :  কয়েক মাস ধরে চাল, পিয়াজ ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এতে জনগণের জীবনযাত্রায় কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?

মির্জ্জা আজিজ : নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বভাবতই জনগণের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে যেসব পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বা তার কাছাকাছি বা যাদের আয় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে বাড়ে না তাদের জীবনযাত্রার মান নিঃসন্দেহে কমে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে চাল, পিয়াজের দামটাও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে অব্যাহতভাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ভার কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?

মির্জ্জা আজিজ : ব্যাংকি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি খেলাপি ঋণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে। তবে তাদের প্রতিষেধক কার্যক্রম মোটামুটি প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ব্যাপারে সরকার যে তদন্ত করিয়েছিল, সেই প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি। এতে স্বভাবতই অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কিছু কর্মকর্তার দায়বদ্ধতা প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে ধন্যবাদ।

মির্জ্জা আজিজ : বাংলাদেশ প্রতিদিনকেও ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর