রবিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অর্থ পাচারে জড়িত এবি ব্যাংক

বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিমের বাড়ি কিনেছে বেশি দামে অর্থের জোগান দিয়েছে বিএনপির আন্দোলনে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক। ব্যাংকটি অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় ৫৪ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩২ কোটি টাকা) পাচার করেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর ডালিমের বাড়ি কিনেছে বেশি দামে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের অর্থের জোগানও দিয়েছে এই এবি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না থাকলেও দুবাইয়ে বিনিয়োগের নামে পাচার করেছে ২০ মিলিয়ন ডলার।

জানা গেছে, বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খানের ছেলে ফয়সল মোরশেদ খান ব্যাংকটির এসব অপকর্মের নেপথ্যে কাজ  করেছেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফয়সল নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে পলাতক হলে এম মোরশেদ খান কৌশলে তার চা বাগান থেকে (ডেউন্ডি ও নয়াপাড়া) এম ওয়াহিদুল হককে এনে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করেন। উল্লেখ্য, ওয়াহিদুল হক মোরশেদ খানের পরিবারের প্রায় ৩৫ বছরের বিশ্বস্ত সঙ্গী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কৌশলী হয়ে বিএনপির অর্থ জোগানদাতা এই ব্যাংককে রক্ষার জন্য এম মোরশেদ খান অপেক্ষাকৃত সুনামের অধিকারী এম ওয়াহিদুল হককে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। এই ওয়াহিদুল হককে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে একের পর এক অপকর্ম করিয়েছেন মোরশেদ খান। এ সময় নানা কৌশলে এবি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫৪ মিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়। এর মধ্যে ইউরো কার নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৫ মিলিয়ন ডলার, এটিজেডের মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন ডলার সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়েছে। রহিমআফরোজের মাধ্যমে ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার ভারতে পাচার করা হয়েছে। সিমেট সিটি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ মিলিয়ন ডলার দুবাইয়ে পাচার করা হয়েছে। তবে সিমেট সিটির মাধ্যমে দুবাইয়ে ২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদিত হলেও তীব্র সমালোচনার কারণে ২০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তরিত হয়। বাকি ৯ মিলিয়ন ডলার সে সময় আর স্থানান্তর করতে পারেনি এবি ব্যাংক।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে খুনিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর ডালিমের মেয়ে স্বস্তি হক তার ৭১৯ সাতমসজিদ রোডের একটি বাড়ি তড়িঘড়ি করে এবি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেন। এতে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে ট্রেনিং একাডেমির নামে ভবনটি কেনা হয়। এই অতিরিক্ত অর্থ মেয়ে স্তস্তি হকের মাধ্যমে মেজর ডালিমের কাছে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। এই জমি কেনার ক্ষেত্রেও ফয়সল মোরশেদ খান বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রথমে আপত্তি জানালেও ফয়সলের চাপে তা পরবর্তীতে চড়া দামেই কিনতে বাধ্য হয়। জানা গেছে, চট্টগ্রামের মাহিন লস্কর নামের এক জাহাজ ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠান মাহিন এন্টারপ্রাইজকে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এবি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ঋণ দেওয়া হয়। পরে এই অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার করা হয়। এ ছাড়া মাহিন চট্টগ্রাম বিএনপির অর্থ জোগানদাতা হিসেবেও পরিচিত। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মাহিন এন্টারপ্রাইজ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ স্বল্প সময়ের মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছিল; যা ওই সময় বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। জানা গেছে, সম্প্রতি এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে ২০ মিলিয়ন ডলার পাচারের যে অভিযোগ উঠেছে মূলত মোরশেদ খানের মেয়েজামাই সাইফুল হকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আটলান্টিক এন্টারপ্রাইজের তদারকিতে তা পাচার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে এবি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সাইফুল হক এবি ব্যাংকের আবু হেনা মুস্তফা কামালকে দুবাইস্থ জনৈক খুররম আবদুল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করাতে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। পরে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক অর্থায়ন এবং Wakala Agreement-এর ভিত্তিতে বিশদ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়। দুবাইয়ে এই অর্থ বিনিয়োগের নামে পাচার করার ক্ষেত্রে মোরশেদ খানের পরিবারই জড়িত বলে জানা গেছে।

মোরশেদ খান পরিবারের এসব অপকর্মের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আবারও অর্থ পাচারের জন্য এম ওয়াহিদুল হককে চাপ দিতে থাকেন ফয়সল মোরশেদ খান। কিন্তু ওয়াহিদুল হক এতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং মোরশেদ খানের অর্থ পাচার কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। ফলে ফয়সল মোরশেদ খান তাকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ করেন। শুধু তাই নয়, ওয়াহিদুল হককে অপসারণের পর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান এম আওয়ালকেও অনৈতিক কাজের জন্য নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন ফয়সল মোরশেদ খান। এজন্য তিনি এম আওয়ালকে ডেকে একাধিক বৈঠকও করেছেন। এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমেও তিনি নতুন চেয়ারম্যানকে চাপ সৃষ্টি করছেন বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, মোরশেদ খান ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে মি. কুন্ডু নামক এক জাপানি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করেন। ওই কোম্পানির নামে হংকংয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৬ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করেন। হংকং পুলিশ জানতে পেরে তা আটকে দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ফেরদাউস খান ও অ্যাটর্নি জেনারেল হংকং সফর করে মামলার আলামত সংগ্রহ করেন। অজ্ঞাত কারণে ওই মামলা পরিচালনা করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সময় ক্ষেপণ করে। এর একপর্যায়ে সবার অজান্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। দুদকের আইনজীবীর মাধ্যমে হাই কোর্টে আপিল করা হলে হাই কোর্ট মোরশেদ খানের বিপক্ষে রায় দেয়। মোরশেদ খান পুনরায় আপিল করেন; যা এখন শুনানির অপেক্ষায় বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর