বুধবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আওয়ামী লীগ

ফেব্রুয়ারির মধ্যে চার সিটিসহ ছয় জেলায় জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী । অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন তফসিল ঘোষণার আগেই প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া । ব্যক্তি নয়, নৌকার পক্ষে প্রচারণা । সরকারের উন্নয়ন ও বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি তুলে ধরা । কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি । টার্গেট ১৭০ আসন

রফিকুল ইসলাম রনি

প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আওয়ামী লীগ

একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর এই মিশনে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে নারাজ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই দলীয় প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, দলীয় প্রার্থী বাছাই, উন্নয়ন প্রচার, বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরতে উঠান বৈঠক, বর্ধিত সভা, কর্মিসভা, পথসভা, জনসভার প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি। গত সোমবার দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক সফর শুরু হয়েছে। নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে জেলায় জেলায় জনসভা করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায়ে জরিপ সম্পন্ন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একটি বেসরকারি ও দুটি সরকারি সংস্থার পরিচালিত জরিপের তথ্য— বেগম খালেদা জিয়ার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় তিনগুণ জনপ্রিয়। আর দল হিসেবেও বিএনপির চেয়ে জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ। এ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেই আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে যেতে চায়। তবে কিছু কিছু জায়গায় অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা উঠেছে ওই জরিপে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, দলীয় প্রার্থী বাছাই এবং বিএনপি-জামায়াতের শাসন আর বর্তমানের উন্নয়নের পার্থক্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে কর্মসূচি পরিকল্পনা করা হচ্ছে। শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামতে ১২টি টিম গঠন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাতে সব ধরনের নির্দেশ দেন তিনি। ব্যক্তির প্রচারণা চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে ওই টিমের আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামার কথা। তবে গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, ত্রাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ

করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, এর মাধ্যমেই জেলায় জেলায় সাংগঠনিক সফর শুরু হয়েছে। 

ব্যক্তি নয়, নৌকার প্রচারণা : দলের কয়েক দফা পরিচালিত জরিপে অধিকাংশ আসনেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি ওঠে এসেছে। এর মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই মনোনয়ন প্রত্যাশীরা স্থানীয় এমপি ও নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অবগত হয়েছেন দলীয় সভানেত্রী। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এতে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে মাঠে বিএনপির সুবিধা হচ্ছে। এ জন্য নির্বাচনী এলাকায় এখন থেকে ব্যক্তির পক্ষে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালাতে নিষেধ করেছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনিবাহী সংসদের বৈঠকে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে কেউ ব্যক্তি প্রচারণা চালাবেন না। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালান। এমপিদের সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, কিছু এমপি মনে করেন-তারা বর্তমানে এমপি আছেন-আগামীতেও তারাই মনোনয়ন পাবেন। কে কী করছেন আমার কাছে সব তথ্য আছে। আগামীতে মাঠ জরিপের তথ্যের ওপর নির্ভর করেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে।

চার সিটিসহ বড় শহরগুলোতে জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী : জাতীয় নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকলেও এখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটিতে নির্বাচনী জনসভা করবেন তিনি। ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার  জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী সফর শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে ওই সিটি ছাড়াও রংপুর, কক্সবাজারসহ বড় বড় শহরগুলোতে জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তিনি দলীয় নেতাদের এমন তথ্য জানিয়েছেন। সে জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

প্রার্থী কে-জানিয়ে দেওয়া হবে আগেই : কোন আসনে কে প্রার্থী তাকে আগেই জানিয়ে দেবে আওয়ামী লীগ। যেন নির্বাচনী মাঠ গুছিয়ে নিতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। আবার যাকে প্রার্থী করা হচ্ছে তাকে নিয়ে জয়লাভের ঝুঁকি আছে-এমন তথ্য পাওয়া গেলে প্রার্থী পরিবর্তন করা সহজ হবে এমনটাই মনে করছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী চূড়ান্ত করার নিয়ম থাকলেও এবার আগে থেকেই প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়ার কথা ভাবছে দলের হাইকমান্ড। ইতিমধ্যে মেয়র নির্বাচনে সিলেট সিটিতে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটনকে মাঠে কাজ করতে বলেছে দলের হাইকমান্ড।

টার্গেট ১৭০ আসন : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে— এমনটাই ভাবছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। গত নির্বাচনে বিএনপি ভোট বর্জন করলেও এবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে মনে করেন তারা। ফলে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। সে কারণে এবার আওয়ামী লীগের মূল টার্গেট টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা। এ জন্য ২০০ আসনের টার্গেট থাকলেও মূল ধরা হচ্ছে ১৭০ আসন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ গোছানো এবং প্রার্থী কে হবেন তাদের সবুজ সংকেত দেওয়ার বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের টার্গেট দলকে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনা। এ জন্যই সাংগঠনিক কর্মসূচিসহ প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। সাংগঠনিক সফরে সরকারের উন্নয়ন ও বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনী সফরে আমরা দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনকে প্রাধান্য দেব। জেলা-উপজেলায় বর্ধিত সভা, কর্মিসভা, বিভাগীয় সভা এবং জনসভা করে নৌকা মার্কায় ভোট চাইব। সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করাই হবে আমাদের কাজ। জনগণের ভোটে আমরা আবার ক্ষমতায় আসব।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের নির্দেশ : নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দলকে নির্বাচনমুখী করার নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক জেলাগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এখন থেকেই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতি ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দলে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নতুন ভোটারদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে দলকে নির্বাচনমুখী করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ সময় ওবায়দুল কাদের নীলফামারী জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব উপজেলা কমিটি হালনাগাদ করার নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে কেউ কমিটি করতে না পারলে কেন্দ্র থেকে কমিটি করে দেওয়া হবে। 

উত্তরবঙ্গের তিন জেলায় শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক জেলার নেতাদের সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টার এ বৈঠকে ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। এর আগে নীলফামারীতে ৪২ হাজার, পঞ্চগড়ে ২৮ হাজার ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৪ হাজার কম্বল বিতরণ করেন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। শীতার্তদের খুঁজে খুঁজে বের করে কম্বল বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা নেতাদের।

সর্বশেষ খবর