মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
মূলধন সংকট

আতঙ্কে ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকরা

মানিক মুনতাসির

দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে মূলধন সংগ্রহের লড়াইয়ে নেমেছে বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাসুদ, উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত ও নিয়োগ পাওয়া নতুন এমডি এহসান খসরুসহ অন্য পরিচালকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মূলধন সংগ্রহে। নতুন প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডার যুক্ত করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন তারা। এদিকে ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টানতে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসক বসাতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংকটির আতঙ্কিত গ্রাহকরা আমানতের টাকা ফেরত পেতে প্রায় প্রতিদিনই আবেদন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। শুধু তাই নয় বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও আতঙ্কের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করছেন। যে কোনো সময় ব্যাংকটির পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনায় আরও বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে কর্মকর্তাদের মাঝে এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, নতুন প্রজন্মের এই ব্যাংকটিতে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় গ্রাহকরা আস্থার সংকটে ভুগছেন। অনেকেই তাদের আমানত তুলে নিতে চাচ্ছেন। খোদ উদ্যোক্তারাই ব্যাংকটিতে আর্থিক অনিয়ম ঘটিয়েছেন বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। অবশ্য তার আগেই ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে তৎকালীন চেয়ারম্যান গত ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। একই সঙ্গে পরিচালকের পদ ছাড়তে হয় মাহাবুবুল হক চিশতীকেও। এরপর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে গত ১৯ ডিসেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত উদ্যোক্তা পর্যায়ের পরিচালকরাই ব্যাংকটি নানা অনিয়ম দুর্নীতি করেছেন বলে খোদ অর্থমন্ত্রী একাধিকবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ফারমার্স ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ক্যাপিটাল বাড়াতে ও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডার নেবে ব্যাংকটি। এজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে এ প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে। শেয়ারহোল্ডার নিতে ও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর পাশাপাশি ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে আরও পরিবর্তন আসতে পারে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকটির মোট মূলধন ১৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৪০১ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন রয়েছে। নতুন শেয়ারহোল্ডার না নেওয়া পর্যন্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিসেম্বর মাসের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও তা কেটে গেছে। চলতি মাসের শুরুতেই সবার বেতন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত। তবে ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থায় শেয়ারহোল্ডার পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার কেনার ব্যাপারে প্রস্তাব দেওয়া হলেও ইতিবাচক কোনো সাড়া মেলেনি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার সংশোধন করে কিংবা নতুন কোনো ব্যবস্থায় ব্যাংকটিকে অন্য কোনো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ (একীভূত) করানো যায় কিনা—সে ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য ও ব্যাংকটির উপদেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়েও আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বেসরকারি খাতের ব্যাংক মার্জ করানোর কোনো আইন এ দেশে নেই। ফলে ফারমার্স ব্যাংককে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করানো যায় কিনা সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সার্কুলার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আইন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এটা একটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টানতে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসক বসাতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মাসের শেষদিকে ব্যাংকটির গুলশান সাউথ এভিনিউ ও গুলশান করপোরেট শাখা পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের প্রতিনিধিরা। ওই পরিদর্শক দল খুব শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা কী হতে পারে তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ওপর। তবে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসানোর ব্যাপারে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকটিতে নিয়োগকৃত নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু কাজ শুরু করেছেন গত সপ্তাহের রবিবার থেকে। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে গ্রাহকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। নিজেদের জমানো আমানতের অর্থ ফেরত পেতে ব্যাংকটির গ্রাহকরা প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন শাখায়। আর প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা টাকা ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করছেন। টাকা ফেরত চাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের ৫০৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ১৫ কোটি টাকা, বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকটির ক্যাপিটাল বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু সমস্যা তো রয়েছেই। আশা করা হচ্ছে এক মাসের মধ্যে এক বা একাধিক নতুন শেয়ারহোল্ডার ব্যাংকটির সঙ্গে যোগ হবেন। এবং ক্যাপিটাল বাড়ানো হবে। এতে ব্যাংকটিতে সৃষ্ট সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। মার্জ করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা একটা কঠিন প্রক্রিয়া। যেহেতু এ রকম কোনো আইন আমাদের দেশে নেই ফলে এতে সময় লাগবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতিই নয় পুরো ব্যাংক খাতেই অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়েছে। যা গ্রাহকদের মাঝে আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া প্রায় সবগুলো ব্যাংকই বিভিন্ন ধরনের সংকটে রয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংক খাতে।

সর্বশেষ খবর