সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

শান্তি সমৃদ্ধি কামনায় আখেরি মোনাজাত

মোস্তফা কাজল, খায়রুল ইসলাম ও মো. আফজাল টঙ্গী থেকে ফিরে

শান্তি সমৃদ্ধি কামনায় আখেরি মোনাজাত

আখেরি মোনাজাতে দেশ-বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি এবং ঐক্য কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আয়োজিত ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমা। গতকাল সকাল ১০টা ২১ মিনিটে দ্বিতীয় পর্বের মোনাজাত শুরু হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল মসজিদের শীর্ষ মুরব্বি হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়েরুল হাসান। শেষ হয় সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে। মোনাজাতে পাপ মোচন, গুনাহ মাফ, নেক হায়াতে তৈয়্যবা দান, সুন্নতি রীতিতে চলার তওফিক দান, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করা হয় আল্লাহর কাছে। মোনাজাতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ সারা বিশ্বে নির্যাতনের শিকার মুসলমানদের রক্ষার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করা হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গতকালও আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে হেদায়েতি বয়ান করা হয়। হেদায়েতি বয়ান করেন মাওলানা আবদুল মনিত। বঙ্গভবন থেকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের শেষ পর্বে অংশ নেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি দরবার হলে বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সরাসরি সম্প্রচারকৃত আখেরি মোনাজাতে যোগ দেন। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঢল নামে ইজতেমায়। পবিত্র হজের পর মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সমাবেশ এই বিশ্ব ইজতেমা। এ কারণে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বলে পরিচিত এটি। দেশ-বিদেশের আলেমরা তাদের বয়ানে ইসলামের মর্মবাণী তথা মানবিক আদর্শ ও ভ্রাতৃত্ববোধের দিকগুলো তুলে ধরেন। আগামী বছর ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি শুরু হবে ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম পর্ব শেষ হবে ২০ জানুয়ারি। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ২৫ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। শেষ হবে ২৭ জানুয়ারি। আখেরি মোনাজাতে অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান মতি, যুুবলীগ নেতা কামরুল আহসান রাসেল সরকার অংশ নেন। বিশ্ব ইজতেমায় প্রতি বছর তাবলিগ জামাতের নিবেদিত প্রাণ কর্মীরা একত্রিত হন। পারস্পরিক ভাব ও ধর্মীয় জ্ঞান বিনিময় করেন। সারা বছরের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন এবং মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ইসলাম প্রচারের কাজে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ব ইজতেমা বর্তমানে আর তাবলিগ কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইজতেমা আজ পরিণত হয়েছে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাবেশে। তাবলিগ জামাত সম্পর্কে যাদের তেমন ধারণা নেই, এমন অনেকেও ইজতেমায় শরিক হন। প্রার্থনা করেন পরম করুণাময়ের রহমত। এবারের ইজতেমায় দুই পর্বে ১০ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মোনাজাতের আগে ইজতেমা ময়দান ছাড়াও দক্ষিণে খিলক্ষেত, উত্তরে বোর্ডবাজার, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত বিশাল এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন। এর আগে গতকাল ভোরের আলো প্রকাশ পাওয়ার আগেই ইজতেমার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে অনেক মুসল্লি মহাসড়ক, সড়ক, উপ-সড়ক, সড়কের অলি-গলিতে অবস্থান নেন। পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন মুসল্লিরা। একই সময়ে দেশব্যাপী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজ নিজ ঘরে, অফিস-ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিভি ও রেডিওর সামনে বসে মোনাজাতে শরিক হন। স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সম্প্রচার, মুঠোফোনের বদৌলতে বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও বহু মুসল্লি মোনাজাতে শরিক হন। মাওলানা যোবায়ের মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের নেক আমল পূরণ কর। রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি দান কর। আমরা যেন নবী (সা.) ও আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে পারি সে তওফিক দান কর। হে আল্লাহ, আমাদের গুনাহ মাফ করে দাও। দ্বীনের পথে চলার শক্তি দাত্ত। এ সময় কেঁদে বুক ভাসিয়ে দুনিয়া ও আখেরাত, দেশ ও বিশ্বের কল্যাণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন মুসল্লিরা। আত্মশুদ্ধি, গুনাহ মাফ ও সবক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত চান মুসল্লিরা। মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই ইজতেমা ময়দানমুখী মুসল্লিদের ঢল নামে। রবিবার ভোরের সূর্য উঠতে না উঠতেই কুড়িল-বিমানবন্দর-আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী-কালীগঞ্জ, আশুলিয়া-সাভার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ বিভিন্ন পথে হাজারও মানুষ হেঁটে আসতে থাকেন ময়দানের দিকে। এমনকি নারীরাও ভিড় ঠেলে আসেন। মোনাজাতের সময় ইজতেমাস্থলের চারপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মিল-কারখানার ভিতর ও ছাদ, ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন যানবাহন এবং নৌকায় বসেও মোনাজাতে শরিক হন বহু মানুষ। মোনাজাত শেষে হেঁটেই ফিরতে হয় এদের প্রায় সবাইকে। যে অল্প কজন মানুষ বাস, পিকআপ বা কোনো যানবাহনে উঠতে পেরেছেন তাদের গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া। আখেরি মোনাজাতকে উপলক্ষ করে গতকাল টঙ্গীর আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। ইজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লিরা আসা-যাওয়ার পথে গাড়ি না পেয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হলেও তাতে তাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। গাজীপুর শ্রীপুরের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন জানান, গতকাল ভোরে প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে ময়দানে এসেছেন মোনাজাতে অংশ নেয়ার জন্য। আবার হেঁটেই বাড়ি যাবেন বলেও জানান। আল্লাহর রহমতে কোনো সমস্যা হবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রায় অর্ধশত বছর আগে দিল্লির কাছে নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) মাজার সংলগ্ন মসজিদকে কেন্দ্র করে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে শুরু করেছিলেন তাবলিগ বা ইসলাম প্রচারের কাজ। এভাবেই গোড়াপত্তন হয়েছিল তাবলিগ জামাতের। আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকায় সর্ব প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, কাকরাইল মসজিদে। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের মিছিরগঞ্জে। অবশ্য এ সমাবেশগুলোকে বিশ্ব ইজতেমা বলা যাবে না। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রাম সন্নিহিত মাঠে যে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিদেশ থেকে তাবলিগ জামাতের অনেক অনুসারী অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তখন থেকেই এটি বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময় থেকে নিয়মিত ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তুরাগ নদের তীরে।

সর্বশেষ খবর