সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্ত্রী সন্তানদের সম্পদের হিসাব নেই হলফনামায়

বেপরোয়া মোতাহার

গোলাম রাব্বানী

স্ত্রী সন্তানদের সম্পদের হিসাব নেই হলফনামায়

সিপাহি থেকে এমপি হয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোতাহার হোসেন। প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, চোরাচালান, মাদক, নিয়োগ ব্যাণিজ্যসহ সবকিছুই এখন তার নিয়ন্ত্রণে। এমনকি ক্ষমতার দাপটে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মীকে। এ ছাড়া এমপি হয়ে যেন তিনি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান (নির্ভরশীল) এবং নিজের নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এই সাবেক প্রতিমন্ত্রী। এমনকি পাল্টে ফেলেছেন নিজের পেশাও। মূলত অষ্টম সংসদে এমপি হওয়ার পর থেকেই পাল্টাতে থাকে তার সম্পদের চিত্র। পরপর তিনবার এমপি থাকার সময় ফুলেফেঁপে ওঠে মোতাহারের সম্পদ। যদিও সেই সম্পদ অর্জনের তেমন কোনো তথ্যই তিনি (নবম ও দশম) সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেননি। নির্বাচনের হলফনামায় নিজের, স্ত্রী-নির্ভরশীলদের (সন্তান) আয়, অস্থাবর-স্থাবর সম্পদের বিবরণী দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেখানে তিনি অনেক তথ্য গোপন করেছেন। এমনকি নবম সংসদের হলফনামায় তিনি নির্ভরশীলদের আয় এবং স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পদ দেখালেও দশম সংসদের হলফনামায় স্ত্রী এবং নির্ভরশীলদের (সন্তান) নামে কোনো সম্পদের তথ্য দেখাননি। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন— মূলত এই এমপি হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। হলফনামায় তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে যে কেউ তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এ কারণে তার এমপি পদও চলে যেতে পারে। বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোতাহার হোসেন এমপি নবম সংসদ নির্বাচনে যেসব তথ্য দিয়েছেন, দশম সংসদ নির্বাচনে তার অনেক তথ্য গোপন করেছেন। নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার পেশা রাজনীতি ও ব্যবসা দেখালেও দশম সংসদে তা পাল্টে নিজের পেশা কৃষি ও ব্যবসা দেখিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি নবম সংসদের হলফনামায় নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর নামে অস্থাবর-স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় এই সম্পদের কোনো তথ্য দেননি। হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নবম সংসদের হলফনামায় মোতাহার হোসেন তার স্ত্রীর নামে ৭২ হাজার টাকা মূল্যের ৭ দশমিক ১২ একর কৃষিজমি এবং ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের ০.৬২ একর অকৃষি জমি দেখান। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ বা অর্থ দেখাননি। যদিও বর্তমানে তার স্ত্রী-নির্ভরশীলদের (সন্তান) সম্পদের কোনো হিসাব নেই। এ ছাড়া তিনি নবম সংসদের হলফনামায় নিজের নামে বাসা দেখালেও দশম সংসদের হলফনামায় তা দেখাননি। তবে নিজের নামে ২০ লাখ টাকার একটি প্লট দেখিয়েছেন। দেখা গেছে, ২০০৮ সালে হলফনামায় এই এমপি নগদ টাকা দেখিয়েছিলেন ৮৫ হাজার। ২০১৪ সালে ১৬ লাখ ৬১ হাজার ১৭৭ টাকা। এ ছাড়া নবম সংসদে ১৬ লাখ টাকার মতো অস্থাবর সম্পদ দেখালেও এবার সেই সম্পদ অনেক গুণ বেড়ে গেছে। দশম সংসদের হলফনামায় তিনি ৯০ লাখের বেশি অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন। 

মোতাহার পরিবারের সম্পদের শেষ নেই : সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের অপরাধ-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর প্রকাশের পর লালমনিরহাট জুড়ে তোলপাড় চলছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় এ পরিবারের দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হওয়ায় সাধারণ মানুষের নজরে এসেছে। অভাবী এলাকা হিসেবে পরিচিত লালমনিরহাট-১ আসনের এই এমপির অর্থবিত্ত, সম্পদ, প্রাচুর্যে ফুলে ফেঁপে ওঠার বিষয়টি সবার মাঝে ঘৃণার উদ্রেক করেছে। তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। একদা সিপাই হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে ডিলার ব্যবসার মাধ্যমে সাধারণ জীবনযাত্রার সাদাসিধে মানুষ বলেই পরিচিত ছিলেন মোতাহার হোসেন। নিরীহ জীবনযাপন, সততা আর আন্তরিকতা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থকদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘প্রিয় মোতাহার ভাই।’ কিন্তু ২০০৯ সালে প্রতিমন্ত্রিত্ব পেতে না পেতেই আমূল বদলে যান তিনি। রাতারাতি নিজেকে আভিজাত্যে মুড়িয়ে নেতা-কর্মীদের তিনি একে একে দূরে ঠেলে দেন। তার পরিবারের একেকজন সদস্য হয়ে উঠেন দোর্দণ্ড দাপুটে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহারের গোটা পরিবার এখন সম্পদের প্রাচুর্যে ভাসছে। তাঁর ছেলে মাহমুদুল হাসানের শখ জায়গা-জমি, বাড়িঘর। তাই লালমনিরহাট, রংপুর থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকায়ও একের পর এক জায়গা জমি কিনেছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন বাড়িঘর। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সবচেয়ে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টসমূহে একের পর এক ফ্ল্যাট কিনে সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন মোতাহার পরিবারের সদস্যরা। শ্যামলীর ২নং রোডে ২৩/২ ডমিনু ভবনের নবম তলায় ৩৬১৮ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটি মাহমুদুল হাসান সোহাগের নামে কেনা। মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে নয় তলাবিশিষ্ট আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টেও প্রায় দুই কোটি টাকা দামে একটি ফ্লোর কিনেছেন তিনি। সেখানে চারটি ফ্ল্যাট নির্মাণ হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বাড়িটির কেয়ারটেকার তোফাজ্জল আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আট তলার পুরো ফ্লোরটি মাত্র এক কোটি ৭৫ লাখ টাকায় কিনেন সোহাগ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ফ্ল্যাটগুলো নিকটাত্মীয়দের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেয়ারটেকার। শ্যামলী ৩ নম্বর রোডে ৯ তলা ভবনের তিন তলার একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন এমপি মোতাহারের ছোট ছেলে মাসুদ। পাঁচ বছর আগে এক কোটি বিশ লাখ টাকায় কেনা মাসুদের ফ্ল্যাটটির এখন বাজারমূল্য ছয় কোটি টাকা বলে জানা গেছে।

লালমনিরহাট-রংপুরেও অঢেল সম্পদ : হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের দীঘিরহাট বাজার ঘেঁষে ২০ শতাংশ জমির ওপর মাহমুদুল হাসানের একটি বাড়ি রয়েছে। একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর ২০ শতাংশ জমি আছে। উপজেলা সদরের টংভাঙ্গা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলপাড়ায় ১০ শতাংশ জমি কিনে তা বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছেন তিনি। হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার সংযোগস্থল লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কে উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের জোড়াপুকুর নামক এলাকায় পেট্রলপাম্প করার জন্য ৩২ শতাংশ জমি কিনেছেন মাহমুদুল হাসান। পাটগ্রাম উপজেলা কলেজ মোড় বাইপাস সড়ক ঘেঁষে ২০ শতাংশ এবং বাউরা ইউনিয়নের আরেফা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে ২৭ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া রংপুরের প্রাইম মেডিকেলের পাশেও কয়েক কাঠা জমি আছে মাহমুদুলের। হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা বাজারে মোতাহার পরিবারের ৫তলা বিশাল মার্কেট রয়েছে। উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ব্র্যাক অফিসের পাশেই আছে মোতাহারপুত্রের আলীশান বাড়ি। মাহমুদুল হাসান সোহাগ রংপুর নগরীর ধাপ লালকুঠি এলাকায় বিয়াম স্কুলের সামনে ১২ তলা ভবনের অষ্টমতলা ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেন। ২০১৩ সালে ৪১ লাখ ৮৬ হাজার টাকায় ফ্ল্যাটটি কিনলেও এখন পর্যন্ত এমপিপুত্র সোহাগ সেখানে বসবাস শুরু করেননি। ওই ভবনের মালিকদের একজন আমিরুজ্জামান পিয়াল জানান, ১৪৯৫ বর্গফুট আয়তনের অষ্টম তলাটি ২ হাজার ৮০০ টাকা বর্গফুট হিসেবে ৪১ লাখ ৮৬ হাজার টাকায় কিনে নেন লালমনিরহাটের এমপি মোতাহার হোসেনের ছেলে মাহমুদুল হাসান সোহাগ। ভবনটির ঠিকাদার মশিয়ার রহমান জানান, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়। সে অনুযায়ী অষ্টমতলার বর্তমান মূল্য ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এমপি মোতাহার হোসেনের পরিবারের পক্ষে সাফাই গেয়ে জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতে বাড়ি থাকা ও গুলশানে মোতাহার টাওয়ার থাকা সংক্রান্ত তথ্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য সম্পদ ও ঢাকার শ্যামলী-ইকবাল রোডের কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনাকাটা নিয়ে কোনোরকম মন্তব্য করেননি নেতারা। রংপুরে একটি ভবনের গোটা ফ্লোর কেনা নিয়েও তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারেননি।

দখলবাজিতেও এগিয়ে : বাবার নামে প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডারবাজি, কাজের ভাগবাটোয়ারা, পাথরের অবৈধ কারবারের নিয়ন্ত্রণ করেন মাহমুদুল হাসান সোহাগ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশের রমরমা বাণিজ্যও করেছে পরিবারটি। টেন্ডারবাজির পাশাপাশি দখলদারিত্বেও বেশ সফলতা দেখিয়েছে এমপি পুত্রদ্বয়। বড়খাতা ইউনিয়নের বুড়া সারেডুবির জয়নাল আবেদিনের দুই একর জমি প্রতিমন্ত্রী নিজেই দখলে নিয়েছেন। তাদের এই দখলদারিত্ব নিজ জেলার গণ্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলাতেও পৌঁছেছে। জেলার ডিমলা উপজেলার শুটিবাড়িতে পাঁচ একর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। একই উপজেলার ডাঙ্গারহাট বাজারে টাঙ্গাইলের নুরুল ইসলামের জমি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোনা মিয়াকে জোর করে দখলে নিয়ে দিয়েছে মোতাহার হোসেনের ছেলে সোহাগ। নুরুল ইসলাম ডিমলা থানায় অভিযোগ করলেও সোহাগের হুমকির কারণে থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েক বছর আগেও মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন এই মাহমুদুল হাসান সোহাগ। বাবা মোতাহার হোসেন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে সোহাগ নাম লেখান রাজনীতিতে। বর্তমানে তিনি হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতি পাল্টে দিয়েছে সোহাগের জীবন। কখনো জাতীয় সংসদ সদস্য লেখা স্টিকার লাগানো গাড়িতে, আবার কখনো কৃষি মন্ত্রণালয় লেখা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ান তিনি। নিজের জন্য রেখেছেন রাজনৈতিক সচিব। ঘুরে বেড়ান অলিখিত পুলিশ প্রটোকল নিয়ে। দখলে নিয়ে রেখেছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের জন্য নির্ধারিত বাড়ি এবং ওই বাড়িতে করেছেন নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়। মাহমুদুল হাসান সোহাগ অবশ্য এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, সংসদের স্টিকার লাগানো গাড়ি ব্যবহার করা তো দূরের কথা, পারতপক্ষে তিনি বাবার সঙ্গেও তার গাড়িতে চড়েন না। বাবা যে কয় বছর মন্ত্রী ছিলেন, তিনি মন্ত্রণালয়েও যাননি। কে ছিলেন তার বাবার পিএস, তা-ও জানা নেই তার। পুলিশ প্রটোকল নেওয়ার সুযোগ নেই। তা তিনি নেনও না। রাজনীতিতে তিনি আগন্তুক নন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে আওয়ামী লীগে এসেছেন বলেও দাবি করেন সোহাগ। উপজেলা চেয়ারম্যান তার চাচা। চাচার বাসা দখল করার দরকার হয় না। চাচার অনুমতিক্রমেই তিনি বাসাটি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন বলেও দাবি করেন মাহমুদুল হাসান সোহাগ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর