রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৌশলে মিয়ানমার!

মন্ত্রীর যাওয়ার দিনেও এলো ২৮৩ রোহিঙ্গা

ঝর্ণা মনি

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত নেওয়াই ছিল প্রধান আলোচ্যসূচি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই বিষয়ে মিয়ানমারের আন্তরিকতার কথা জানালেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্টমহলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো উদ্যোগই নেই মিয়ানমারের। এসব বৈঠক অনেকটা লোক দেখানো। আন্তর্জাতিকমহল যেন তাদের ওপর কোনো চাপ তৈরি না করতে পারে, সে জন্য বৈঠকের নাম করে সময় নষ্টের কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার।

শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। বরং বাংলাদেশের দেওয়া ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা যাচাই-বাছাই করে দেখে তাদের নাগরিক হলে ফেরত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক কূটনৈতিক মো. জমির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের উচিত ছিল, মিয়ানমারের মন্ত্রীকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। আর নৈতিক কারণেই তাদেরও উচিত ছিল, তাদের জনগণকে দেখতে যাওয়া। কী কারণে তারা সেখানে যাননি? তারা ক্যাম্পে যাওয়ার কথাও উচ্চারণ করেনি একবার। ক্যাম্পে গেলে নিশ্চয়ই আর বলতেন না, যাচাই-বাছাই করে দেখবেন তাদের জনগোষ্ঠী কি না?’ যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার খুবই আন্তরিকতা দেখিয়েছে। তারা তিনটি ধাপে ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। প্রাথমিক অবস্থায় রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়িঘর তৈরি করবে। পরে তারা সেখানে যাতে থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা করবে। এরপর তাদের নাগরিকত্ব দেবে।’ তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। প্রত্যাবর্তন হতে হবে স্বেচ্ছায়। বিদ্যমান আইনের আওতায় হতে হবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের অবহিত থাকার বিষয়ে সম্মান জানাতে হবে। তারা কোথায় ফিরে যেতে চায় সেটা তাদেরকে বেছে নিতে দিতে হবে। যে বাড়ি ফেলে এসেছেন, তাদের সেখানে ফিরে যাওয়ার অধিকার দিতে হবে। তাদের কোনো ক্যাম্প বা আশ্রয় শিবিরে পাঠানো উচিত হবে না। এসব শর্ত পূরণ হলেই প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক কূটনৈতিক হুমায়ুন কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো উপযোগী পরিবেশ রয়েছে কি না, তারা স্বেচ্ছায় সেখানে ফেরত যেতে চান কি না, সেখানে নিরাপদ পরিবেশে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে কি না— এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় না হলে তারা সেখানে ফেরত যেতে পারছে না। ফলে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল।’  সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে যদি খাবার না পায়, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় এবং বাসস্থান না পায়, তাহলে আবার চলে আসবে। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রত্যাবর্তন বিষয়টি। এ ব্যাপারে সাবেক কূটনৈতিক মো. জমির বলেন, দ্রুত প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করা অসম্ভব। আর পুরোপুরি সম্ভব হবে কি না তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে জাতিসংঘের চাপপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর। তারা সঠিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করলে মিয়ানমার তাদের ১১ লাখ অভিবাসীকে ফেরত নিতে বাধ্য হবে। নতুবা কিছু কিছু ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ এত বিশাল জনগোষ্ঠী একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সব কিছু ফেলে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সব হারিয়েও তারা এদেশে নিরাপদে রয়েছে। কিন্তু দেশে ফেরত গেলে নিরাপত্তাটুকু থাকবে না। আবার একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। কিন্তু আমাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই আমরা ফেরত নেওয়ার কথা বলেছি। মিয়ানমার বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার আসলে কালক্ষেপণ করছে। আর জাতিসংঘ এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করছে না। জাতিসংঘ বারবার বলছে, অনিরাপদ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত দেওয়া যাবে না। কিন্তু তারা মিয়ানমারকে কিছু বলছে না। পরিস্থিতি ভালো হলে নেওয়া হবে কিন্তু পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে আর কতদিন? এ বিষয়ে শরণার্থী ও প্রত্যাবর্তন বিষয়ক বাংলাদেশি কমিশনার আবুল কালাম বলেন, প্রত্যাবর্তন একটি দীর্ঘসূত্র বিষয়। চুক্তির মধ্যেই রয়েছে কীভাবে প্রত্যাবর্তন হবে। আর পুরোপুরি প্রত্যাবর্তন হবে কি না এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মন্ত্রী যাওয়ার দিনেও এলো ২৮৩ রোহিঙ্গা : টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে আবারও অনুপ্রবেশ করেছেন ৭২ পরিবারের ২৮৩ জন রোহিঙ্গা। তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গতকাল টেকনাফের হারিয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে আসেন। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াও সুইকফির কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৬৭৩ রোহিঙ্গা পরিবারের ৮ হাজার ৩২ সদস্যের তালিকা হস্তান্তরের পরদিনই এ ঘটনা ঘটল। সাবরাং হারিয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে দায়িত্বরত জেলা প্রশাসকের (ডিসি) প্রতিনিধি ও টেকনাফ উপজেলা জ্যেষ্ঠ মত্স্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত নতুন করে ৭২ পরিবারের ২৮৩ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। প্রথমে তাদের সেনাবাহিনীর হারিয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এরপর মানবিক সহায়তা ও প্রতিটি পরিবারকে চাল, ডাল, সুজি, চিনি, তেল, লবণের একটি করে বস্তা দিয়ে গাড়িতে করে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, কোনোভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৮৬ পরিবারের ১ হাজার ৭২৭ জন রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছেন। তাদের সবাইকে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী কেন্দ্রের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে পাঠানো হয়েছে। গতকাল অনুপ্রবেশ করা মিয়ানমারের রাচিডং হাংডং গ্রামের আবদুুল গফফার ও নুরবাহার, বুচিডং পুইমালি গ্রামের মো. সালাম এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘মংডু ঢংখালী নাফ নদের পাড়ে ১০ দিন অপেক্ষার পর শুক্রবার দিনগত রাতে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছি। মিয়ানমারে নিজ বাড়িঘর থেকে বের হতে না পেরে অনেককেই অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হচ্ছিল। মিলিটারির ভয়ে পাহাড়ে কাঠ সংগ্রহ, নদীতে মাছ ধরাসহ আয়-রোজগারের সব পথ বন্ধ ছিল। ফলে সেখান থেকে পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর