শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : আ হ ম মুস্তফা কামাল

উন্নত বিশ্ব গড়ার চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ

গোলাম রাব্বানী

উন্নত বিশ্ব গড়ার চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি সমৃদ্ধ দেশ, শান্তির দেশ এবং উন্নত দেশ। তিনি বলেন, ‘ধনী দেশ বলতে পৃথিবীর ২০টি দেশকে বোঝায়। আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে, আমরা একটি ধনী দেশে রূপান্তরিত হব। এজন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিক করিডরে অবস্থান করছে। আগামী ৫০০ বছর এশিয়া প্যাসিফিক করিডর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। বর্তমানে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬০ ভাগের কাছাকাছি। ২০৪১ সালে তা হবে ৭০ ভাগ।’ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তখন আমাদের প্রতিটি ক্লাসরুম হবে টেইলর মেট। সেই ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া হবে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি। সেখানে পড়ানো হবে রোবোটিকস, পড়ানো হবে ইন্টারনেট সর্ট অব থিংস, পড়ানো হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেঞ্জ, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স।’ ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর দেওয়া এক ব্যতিক্রমী বক্তৃতায় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলেছেন। সেই স্বপ্নে দেশ গড়ার সব ব্যাখ্যা তিনি সংসদে না দিতে পারলেও রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এর বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার সক্ষমতার নানা দিক ও দেশের রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। উন্নত বিশ্বে প্রবেশের স্বপ্ন পূরণে কী কী শক্তি কাজ করছে— জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘নয় বছর আগে পৃথিবীর অর্থনীতির এলাকায় আমাদের অবস্থান ছিল ৫৮তম। মাত্র নয় বছরে আমরা সেই ৫৮তম থেকে ৪৩তম স্থানে এসেছি। নয় বছরে ১৫টি সিঁড়ি ভেঙে আমরা এ অবস্থানে এসেছি। যদি নয় বছরে আমরা ১৫টি সিঁড়ি ভাঙতে পারি, তবে ২০৪১-এ পৌঁছানোর জন্য আমাদের হাতে আছে এখনো ২৩ বছর। এই ২৩ বছরে আমাদের প্রয়োজন আর ২৩টি সিঁড়ি ভাঙা। এই ২৩টি সিঁড়ি ভাঙলেই আমরা ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের একটি উন্নত দেশ হব, যার স্বপ্ন দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দেখতে চান, পৃথিবীর এ-২০-এর মতো যে এলিট গ্রুপ, সেই এলিট গ্রুপের দেশের মতো একটি দেশ হবে বাংলাদেশ।’ পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘২০২১ সালে এই দেশে আমাদের সব ছেলেমেয়ে অন্তত প্রাইমারি শিক্ষা সমাপ্ত করবে, আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে, বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন আমাদের ২০২১ সালের যে স্বপ্ন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হবে মধ্য আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত।’ ধনী দেশে পৌঁছতে হলে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে— এমন প্রশ্নে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে পৌঁছতে গেলে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমাদের জনশক্তিকে সত্যিকার সম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আরও কর্মক্ষম করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এজন্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। আর তা করতে না পারলে ২০৪১ সালের স্বপ্ন পূরণ করা কঠিন হবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে হবে। শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে। যদি আমরা উন্নত দেশের দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্লাসরুমে পড়ানো হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি। সেখানে পড়ানো হয় রোবোটিকস। আমাদের ক্লাসরুম সে রকম হবে। আমাদের প্রতিটি ক্লাসরুম হবে টেইলর মেট। সেই ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া হবে ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি। সেখানে পড়ানো হবে রোবোটিকস, পড়ানো হবে ইন্টারনেট সর্ট অব থিংস, পড়ানো হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেঞ্জ, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এবং আরও যেসব বিষয় আছে এ লাইনে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং থেকে শুরু করে সবকিছু সেখানে পড়ানো হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এ কাজটি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা আধুনিক শিক্ষায় রূপান্তর করতে পারি, তাহলে আমাদের ২০৪১ সালের স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ করতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা ৭.২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। এটি এর আগের বছর ছিল ৭.১১ এবং তারও আগের বছর ছিল ৬.৫৫। এ বছর আমরা ভালো করব। গত বছরের চেয়ে ভালো হবে। কেননা ভালো না হওয়ার কোনো কারণ নেই। রেমিট্যান্স কমেনি। রেমিট্যান্সের গ্রোথ এবার অনেক বেশি। এ বছর আমাদের রেমিট্যান্স হবে ১৫ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানিও বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্লু ইকোনমি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে, সার্ভে হচ্ছে। আমরা অবকাঠামোগুলো তৈরি করছি।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সামনে যেসব মেগা প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। পদ্মা সেতু বলুন, এমআরটি বলুন, রাস্তাঘাট, মেট্রোরেল যা-ই বলুন, সব খাতেই আমাদের অনেক বেশি গতি আনতে হবে। আর গতি আনতে পারলে আমরা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ পাব। আমাদের নিজস্ব বিনিয়োগ, বাইরের বিনিয়োগ দুটো একসঙ্গে করে আমরা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘সব মেগা প্রকল্পে রাত-দিন কাজ চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেনের ব্রিজের কাজগুলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। পায়রা বন্দরের কাজ শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ী প্রকল্প শুধু একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, এখানে সবকিছু আছে। এখানে টাউনশিপ আছে, শিল্পায়ন আছে, শিল্পের জন্য বিশেষ ইকোনমিক জোন থাকবে এবং এটি হবে একটি ডিপ সি পোর্ট (গভীর সমুদ্রবন্দর)। পাশাপাশি এখানে স্টক ইয়ার্ড থাকবে, ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা সব সময় থাকবে সেখানে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের হাতে প্রায় ১৫০০ প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আগামী ১০-১৫ বছর আর অবকাঠামোগত কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন হবে না।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের রয়েছে যুবসমাজ। বর্তমানে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬০ ভাগের কাছাকাছি। ২০৪১ সালে তা হবে ৭০ ভাগ। এই জনগোষ্ঠীকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে ১০০ অর্থনৈতিক জোন করে দেওয়া হয়েছে। অনেকটি বাস্তবায়নে চলে গেছে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘১০০ ইকোনমিক জোন করা হয়েছে কর্মসংস্থান জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। আমাদের কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। যে যেখানে ইচ্ছা কলকারখানা করছে। আর এসব বন্ধ করতে ইকোনমিক জোন করা। কলকারখানা করতে গেলে নির্দিষ্ট এলাকায় করতে হবে।’ ই-টেন্ডার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ই-টেন্ডারের টার্গেটের মধ্যেই আমরা আছি। গত দুই বছর টেন্ডার নিয়ে হাতাহাতি-মারামারি হয় না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।’ পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা দিতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগের কোনো অভাব হবে না। এলএনজি আমদানি শুরু হলে সে সমস্যা থাকবে না। সম্প্রতি ভোলায় দুটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এ দুটি গ্যাসক্ষেত্র যুক্ত হওয়ায় মজুদ বাড়বে ১.৫ টিসিএফ গ্যাস। কয়লাখনি থেকেও বিদ্যুৎ খাত আরও উন্নত হবে। এ ছাড়া এলএনজি গ্যাস আমরা সরাসরি নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমি বলেছিলাম, এপ্রিল থেকে এলএনজি গ্যাস আমরা দিতে পারব। আর তাও না হলে মে মাসে। এলএনজি গ্যাস আমরা যখন দিতে পারব, তখন বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসবেন।’ পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। যারা কাজের উপযোগী, আমরা তাদের প্রত্যেকের কাজের ব্যবস্থা করব। কর্মসংস্থান আমাদের দেশে হবে, দেশের বাইরে হবে। গত বছর ১০ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে গেছে। আমরা আমাদের কর্মক্ষম মানুষকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করব। তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেড়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশে কর্মক্ষম মানুষ নেই। এটাও আমাদের বড় একটা শক্তি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আমাদের অবস্থান। আমরা এশিয়া প্যাসিফিক করিডরে আছি, যে করিডরটি ভাইব্রেট। আগামী ৫০০ বছর এই করিডর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। গত ৫০০ বছর নেতৃত্ব দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। আগামী ৫০০ বছর নেতৃত্ব দেবে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো। এশিয়া হবে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির অঞ্চল।’

 তিনি বলেন, ‘২০৩২ সালে এক নম্বর হবে চীন। দুই নম্বর হবে আমেরিকা, তিন ভারত আর চার নম্বর হবে জাপান। পৃথিবীর এই চারটি বড় দেশের মধ্যে তিনটিই আমাদের সঙ্গে রিলেটেড। এর মধ্যে এক আর তিন— একটা ডান দিকে, একটা বাঁ দিকে। আমরা মাঝখানে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, প্রতিবেশী যখন উন্নতি করে, একা তা করতে পারে না। সেটি হলো, এই যে পরিবর্তন পৃথিবীতে, আমরাও সেই পরিবর্তনের অংশীদার। আমরাও সেই পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, যাতে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক কানেকটিভিটি শুরু হয়েছে। এখন তা শক্তিশালী করতে হবে। আর শক্তিশালী করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশে রূপান্তর করা। প্রতিটি নদী আমরা ড্রেজিং করব। এ ক্ষেত্রে নদীর প্রবাহ অরিজিনাল জায়গায় নিয়ে যাব। তাহলে কৃষি বাঁচবে, বাঁচবে কৃষক। রাস্তার একপাশে থাকবে রেললাইন, অন্যপাশে থাকবে গাড়ি চলার ব্যবস্থা, বাকি জমিতে হবে কৃষিকাজ।’ শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের কাজ চলছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এ কাজ জাপান করছে। এ ছাড়া আমাদের আরেকটি বিমানবন্দর হবে, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অনেক জায়গা আমরা সার্ভে করেছি। এর মধ্যে একটিকে আমরা বেছে নেব। এটি হবে পদ্মার ওপারে। তবে সেখানে যেতে খুব সময় লাগবে না।। আমরা চাই ট্রেনটি এখন ট্র্যাকের ওপর আসছে, এটা সামনে এগিয়ে যাক।’ মন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে হলে খুবই ভালো। টেকসই উন্নয়ন হবে। আর বাধাগ্রস্ত হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। আমি বিশ্বাস করি ভুল-ভ্রান্তি আর হবে না। সবাই ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেবে। আমরা জনগণের ভোট নিয়ে নির্বাচন করব। জনগণের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে।’

সর্বশেষ খবর