রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংকে নয় টাকা এখন বাড়িতে

হুন্ডির মাধ্যমে পাচারের আশঙ্কায় ১০০০ টাকার নোট বাতিলের প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিত্তশালীদের অনেকেই এখন ব্যাংকে না রেখে টাকা রাখছেন নিজ বাড়িতে। এতে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরের এই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যেতে পারে। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত সময় দিয়ে সার্কুলারের মাধ্যমে সেই অর্থ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকার। অন্যথায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো এক হাজার টাকার নোট বাতিল করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে এবং সার্বিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এ ধরনের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। সূত্রমতে, নানা কারণে বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত কঠিন সংকট অতিক্রম করছে। এর মধ্যে অন্যতম সংকট হলো আস্থার সংকট, যার কারণে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এ জন্য এ খাতে অর্থ ফিরিয়ে আনতে (স্থায়ী সঞ্চয়) এফডিআরের সুদের হার বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুদের হার বাড়ানো হলে একদিকে যেমন মধ্যবিত্তরা আমানতে উত্সাহিত হবেন, অন্যদিকে বিত্তশালীরাও ব্যাংকে টাকা রাখবেন। এ ছাড়া সংক্ষিপ্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিত্তশালীদের হাতে থাকা নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা দেওয়ার নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে। অন্যথায় সময়সীমার পর এক হাজার টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংক তাদের বিভিন্ন স্কিমে আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক ইতিমধ্যে আমানতের সুদের হার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ঋণের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার অন্যতম কারণ আস্থাহীনতা। ব্যাংকের বাইরে বেশি পরিমাণে অর্থ চলে গেলে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সংকটে পড়েন। এ ছাড়া কালো টাকা বেশি পরিমাণে হাতে থাকলে তা বিদেশে পাচার করার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা আস্থার সংকট তো রয়েছেই। এ জন্য ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরানো জরুরি। পাশাপাশি আমানতের সুদের হার বাড়ালে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা লাভবান হবেন। এটা করা যেতে পারে। তবে নোট বাতিলের জন্য প্রয়োজন সরকারি সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া মানুষ ব্যাংক থেকে কেন আমানত তুলে নিচ্ছে সে বিষয়টা বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ কমছে। গত ছয় মাসে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য আস্থার সংকট ও আমানতের সুদের হার কমানোকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিকে অনেকেই ব্যাংকে করা এফডিআর ভেঙে ফেলছেন। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকাররা। কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ অব্যাহতভাবে কমছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। মাস ছয়েক আগেও দেশের ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকাররা জানান, নতুন-পুরনো বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নতুন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিরাপদ বোধ করছে না। পুরনো বেসরকারি ব্যাংক থেকেও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো, যার প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। এসব ঘটনায় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছেন। তবে শুধু আস্থার সংকটই নয়, পাচারের উদ্দেশ্যেও মোটা অঙ্কের এফডিআর ভেঙে ফেলছেন বিত্তশালীরা, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগদ অর্থের সংকটটা সাময়িক এবং এটি পুরো ব্যাংক খাতের চিত্র বহন করে না। এটি নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংকের সমস্যা। তবে টাকা পাচার করা আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের এক ধরনের রোগ। অন্যদিকে নোট বাতিলের মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নোট বাতিল হতেই পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন হবে সরকারি সিদ্ধান্তের। যেমন ভারতে নোট বাতিল করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে।’ এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। গত কয়েক মাসে ঋণ বিতরণের ফলে তা ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ঋণই গেছে সরকারি ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংক খাত থেকে এই সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে আমানতও তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা।

সর্বশেষ খবর