বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাফল্যের স্বর্ণশিখরে বাংলাদেশি নারীরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সাফল্যের স্বর্ণশিখরে বাংলাদেশি নারীরা

নারীদের জয়যাত্রা পৌঁছেছে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। সাফল্যের জোয়ার বইছে সব ক্ষেত্রে। মহাকাশ, আকাশ থেকে শুরু করে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় বিজয়ের পদচিহ্ন এঁকে চলেছেন বাংলাদেশের নারীরা। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু হয়ে ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য আর অগ্রযাত্রায় বিশ্বকে জয় করে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের অপরাজিতারা।

বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে সরকারি ও বিরোধী দুই দলের প্রধান এবং জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। সংসদে বর্তমানে সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন এমপি রয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪২ জন, জাতীয় পার্টির ছয়জন এবং জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির  একজন করে দুজন। এর বাইরে চলতি সংসদে ২২ জন নারী এমপি রয়েছেন, যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন অনেক মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। ক্রীড়াঙ্গনে একের পর এক সাফল্যের জোয়ার বয়ে আনছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এরই ধারাবাহিকতায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের তরুণীরা। ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেশের মানুষের জন্য মুঠোভরা আনন্দ উপহার দেয় এই মেয়েরা। প্রতিযোগিতায় দাপটের সঙ্গে খেলেছে তারা। নামের পাশে ‘অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন’ কথাটা তারই পরিচায়ক। প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত খেলা আঁখি খাতুন, শামসুন্নাহার, মনিকা চাকমা, ইয়াসমিন নীলা ও মাহমুদা আক্তারদের হাত ধরে দেশের প্রমীলা ফুটবল যে অনেক দূর এগিয়ে যাবে, এ নিয়ে এখন আপাদমস্তক নৈরাশ্যবাদীরও সন্দেহের অবকাশ নেই। সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের দুই নারী অ্যাথলেট মাবিয়া আক্তার সীমান্ত ও মাহফুজা খাতুন শিলা ভারোত্তোলন ও সাঁতারে সোনা জয় করে দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান।

নারীর অগ্রযাত্রায় একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র সায়মা ওয়াজেদ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ‘অটিজম বিষয়ক চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশে অটিজম মোকাবিলা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

এদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশি তিন কন্যার জয়ের ধারাবাহিকতা রয়েছে অব্যাহত। নিজ নিজ আসনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা হক। এর মধ্যে টিউলিপ ও রূপা দ্বিতীয়বারের মতো আর রুশনারা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন। টিউলিপ বিজয়ী হয়েছেন লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে, রুশনারা বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন থেকে এবং রূপা বিজয়ী হয়েছেন লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে। আগের বারও তারা একই আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা এবং অব্যাহত বিজয়ে বাংলাদেশকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছেন এই ‘তিন কন্যা’।

মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে যে কজন বাংলাদেশি নারী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত, এর মধ্যে একজন সোনিয়া বশির কবির। টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োজিত করেছে বেশ আগেই। নতুন আরও তিনটি দেশ নেপাল, ভুটান ও লাওসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন তিনি। নতুন দায়িত্বে সামনের দিনগুলোতে এই চারটি দেশে মাইক্রোসফটের ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের কাজ করবেন তিনি এবং এ লক্ষ্যে যাবতীয় ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তার ওপরই নির্ভর করবে। মাইক্রোসফটে কাজের পাশাপাশি সোনিয়া বশির কবির জাতিসংঘের আওতাভুক্ত টেকনোলজি ব্যাংক ফর ডেভেলপড কান্ট্রিজের (এলডিসিএস) গভর্নিং কাউন্সিল মেম্বার হিসেবে কাজ করে চলেছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি সপ্তাহে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) সংক্রান্ত সেরা ১০ পথিকৃতের একজন হিসেবে ইউএন গ্লোবাল কমপ্যাক্ট সোনিয়া বশির কবিরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রার পথে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এই নারী।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা থেকে ‘ইনভেন্টর অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের মাহমুদা সুলতানা। ন্যানো মেটারিয়ালের ভূমিকা বৃদ্ধি করে মহাকাশে ব্যবহার উপযোগী অভিনব ডিটেক্টর যন্ত্রপাতির নির্মাণ কৌশল ও প্রয়োগ উদ্ভাবনের জন্য ২০১৭ সালে নাসার কনিষ্ঠ এই রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার আইআরডি ‘ইনভেন্টর অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ন্যানোটেক কাউন্সিলে নাসার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সাত বছর ধরে নানা রকম প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও কঠিন পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের দুজন নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও তামান্না-ই-লুতফী। চলার পথের সব বাধা উপেক্ষা করে নারীদের প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে যাওয়ার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা।

বুনেছেন সফলতার গল্প আর পাশাপাশি দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন জয়ের বার্তা। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার বাস্তবতায় কঙ্গোর অচেনা আকাশকেও হার মানিয়েছে অদম্য অপরাজিতাদের হাত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভরি কোস্টে মেডিকেল কন্টিজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রথম বাংলাদেশি নারী কর্নেল নাজমা বেগম।

অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম নারী হিসেবে মিশনে মেডিকেল কন্টিজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। প্রত্যন্ত জনমানবহীন গ্রামে অনেক সময় ভারী অস্ত্র ছাড়াই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাদের। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নারীরা পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি।’ হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টও দুর্গম নয় বাঙালি নারীদের কাছে। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে লাল-সবুজ পতাকা মেলে ধরেছেন নিশাত মজুমদার। এরপর আরেক বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীনও এভারেস্টের বুকে এঁকে দেন বিজয়ের পদচিহ্ন। বাংলাদেশের সাফল্যের প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে আছে সাহসী নারীদের বীরত্বের গল্প। তেমনই একজন ঝালকাঠির মেয়ে শারমীন। ২০১৫ সালে নবম শ্রেণি পড়ুয়া শারমিনকে বিয়ের আগেই জোরপূর্বক এক ছেলের সঙ্গে একই ঘরে থাকতে বাধ্য করেন তার মা। নানা বাধা-বিপত্তির পর ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট সহপাঠী নাদিয়ার সহযোগিতায় মা ও কথিত স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে শারমিন। শারমিনের এই অদম্য সাহসিকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউসি) ২০১৭’ পুরস্কার পেয়েছে শারমিন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৭ সাল থেকে সাহসিকতার জন্য নারীদের এই মর্যাদা দিয়ে আসছে। নতুন করে আবার জীবন শুরু করা শারমিনের লক্ষ্য, দেশ থেকে বাল্যবিবাহ নামের বিষবৃক্ষের গোড়া সমূলে উত্খাত করা। এমন শারমিনদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বিশ্বকে জানিয়ে দেবে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সাফল্যগাথা।

সর্বশেষ খবর