বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমার প্রস্তাবমতো বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেয় হাউস

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম

আমার প্রস্তাবমতো বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেয় হাউস

মার্চ মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মনে হয় যেন ২৫ যুগ পার করেছি। ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দাবি করেছিলেন। সেই নিরিখে আমাকে এবং ড. কামাল হোসেনকে একটি খসড়া সংবিধান রচনা করতে বলেছিলেন। সেই সংবিধান লেখা শেষে যখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে সেটি পাঠ করছি তখন রেডিওতে বেজে উঠল ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা, ‘সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।’ আমি ছিলাম পার্টির হুইপ। আমাকে বলা হয়েছিল দুই হাউসের (জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের) সঙ্গে বসে পূর্বাণী হোটেলে অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে। আমরা সব পরিকল্পনা শেষ করলাম। কোথায় অধিবেশন হবে, কোথায় খাওয়া-দাওয়া হবে সব ব্যবস্থা শেষ করলাম। পূর্বাণী হোটেলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে দেখি মানুষ মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট আমাকে জানাল, পাকিস্তান আর্মি তাদের ফোন করে ভয় দেখাচ্ছে। বলা হয়েছে, অধিবেশন হলে ট্যাঙ্ক দিয়ে হোটেল গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। আমি তাদের বললাম, মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তখন আমি দ্রুত আমার খাতায় দুটো প্রস্তাব লিখে ফেললাম। একটাতে সবার সঙ্গে আলোচনা না করে ইয়াহিয়া খান যে অধিবেশন স্থগিত করেছেন এজন্য নিন্দা জানানো হলো। আর আরেকটি প্রস্তাব হলো এই পরিবর্তিত অবস্থায় উভয় হাউসের সবার পক্ষ থেকে দেশ পরিচালনার পুরো ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে অর্পণ করা হলো এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা এই হাউসের সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হবে। এ সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। তিনি অনুমোদন দিলেন এবং সবাইকে পাঠ করে শোনালাম। সবাই করতালির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন। এ দিন থেকে আমরা সাংবিধানিকভাবে ন্যায়সংগত সরকারে পরিণত হলাম এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা বৈধ সিদ্ধান্ত হবে। এর ভিত্তিতে তিনি ৩ মার্চে ছাত্রলীগের সম্মেলনে কথা বললেন এবং ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। পুরো মার্চ মাস বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটি টাস্কফোর্স কাজ করে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আমি এবং ড. কামাল হোসেন সেই টাস্কফোর্সে কাজ করতাম। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, টেলিগ্রাফ অফিস, ওয়ারলেস, ব্যাংক, ট্রেড ইউনিয়ন এ রকম বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লাইব্রেরি রুমে বসে খসড়া তৈরি করে রাখতাম। পরে সেগুলো সারসংক্ষেপ করে বঙ্গবন্ধুকে দেখাতাম এবং তিনি যা নির্দেশনা দিতেন তা পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সংবাদপত্রে চলে যেত। সব রেকর্ড, নোট সাজিয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার সঙ্গে অনেকাংশেই মিলে যেত আমাদের লেখা খসড়া। আসলে চিন্তাভাবনা-আদর্শের জায়গা মিলে গিয়েছিল, যেমন দেশবাসীর চিন্তা এক ধারায় মিলেছিল আর তাই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে। কারণ পাকিস্তানি আর্মিদের অ্যাটাক বেড়ে গিয়েছিল। রংপুর, গাজীপুরে সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু সকাল থেকেই সব পুলিশ লাইনস, থানা, হেডকোয়ার্টারগুলোতে সংরক্ষিত সব অস্ত্র আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী রাজারবাগে হাজী গোলাম মোর্শেদকে পাঠানো হলো এসপিকে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পৌঁছে দিতে। এরপর অন্যান্য জায়গায় টেলিফোন করলাম, সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের একত্রিত হতে বলা হলো। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে বাড়ি থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হলো। তার পরও অনেককেই জিপে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। ২৫ মার্চ রাতে লালমাটিয়ায় রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাসায় আশ্রয় নিই তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে। প্রথমেই চেষ্টা করেছিলাম কুষ্টিয়াতে যোগাযোগ করতে। কিন্তু টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। শুধু চুয়াডাঙ্গাতে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলতে বিদেশি সাংবাদিকদের পাঠানো প্রতিবেদন অনেক সহায়ক হয়েছিল। এজন্য ২৫ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেসব সাংবাদিক অবস্থান করছিলেন তাদের বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলে পাকিস্তানি আর্মি। কিন্তু কয়েকজন সাংবাদিক এটা আগেই বুঝতে পেরে হোটেলের ছাদে পালিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে তাদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং আমাদের স্টেটমেন্টে বিশ্বের সামনে উঠে আসে পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যার চিত্র। আর এই নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ জানায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এবং তৈরি হয় বিশ্ব জনমত। অনুলিখন : জয়শ্রী ভাদুড়ী

সর্বশেষ খবর