সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

জেগেছে প্রাণ আজ

মাহমুদ হাসান

জেগেছে প্রাণ আজ

স্বাধীনতা নাড়ির স্পন্দন। চাঁদের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে নামা জ্যোত্স্না। স্বাধীনতা পাহাড়ের শিখরে সূর্যের হাসি। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটা। স্বাধীনতা তুমি এত সুন্দর যেন মায়ের মুখ। ‘নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি’। হাসি-কান্না, আশা-হতাশা, স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা তুমি আমাদের। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার। স্বাধীনতা তুমি বাংলাদেশ,   আমাদের ভালোবাসা। আজ ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাতচল্লিশতম বার্ষিকী। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। তোমাকে অভিবাদন প্রিয় স্বাধীনতা, প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। জাতি অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদযাপন করছে মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস মানে উৎসবের দিন, আনন্দের দিন। উৎসবে-আনন্দে জেগেছে প্রাণ আজ, প্রাণে প্রাণে সৃষ্টি সুখের উল্লাস। জাগো প্রাণ, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার শপথে মিলি প্রাণের উৎসবে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ বছর দেশে একযোগে একই সময়ে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে। আজ সকাল ৮টায় রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা দেশে ও বিদেশে একযোগে একই সময়ে পরিবেশন করা হবে জাতীয় সংগীত— ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত চর্চাকে অনুপ্রাণিত করতে এই প্রথমবারের মতো দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে দলগত জাতীয় সংগীত পরিবেশন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতায় ৬৪টি জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসার সোয়া কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সাতচল্লিশ বছর আগে ১৯৭১ সালে এসেছিল অগ্নিঝরা মার্চ। দুর্ভেদ্য ঐক্য আর দুর্জয় সংকল্পে ‘বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা গর্জনে উন্মাতাল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল/গণজোয়ারে ভাসে পদ্মাপাড়, টেকনাফ কূল, তেঁতুলিয়া বন/মুজিবের বাংলাদেশ চায় স্বাধীনতা।’ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। যার উদগাতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার মুখে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) তথা সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অর্থাৎ বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নে উজ্জীবিত করেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতি জানায় অকুণ্ঠ সমর্থন। শুরু হয় জনরায়ের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র। আসে একাত্তরের আগুনঝরা মার্চ। বাঙালির হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর না করার দুরভিসন্ধির প্রতিবাদে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। দলমত নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন। সে আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধিকার সংগ্রামে। জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিব রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ডাক দেন স্বাধীনতার। শোনান মুক্তির মহাকাব্য, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার সমার্থক সেই ডাকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু করে ভয়াবহ গণহত্যা, যার নাম অপারেশন সার্চলাইট। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে হানাদার বাহিনী শুধু ঢাকা শহরেই হত্যা করে অর্ধলক্ষাধিক মানুষকে। সেই রাতে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবন থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাধীনতা ঘোষণা দেন— “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন”। স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। সর্বস্তরের নাগরিককে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করুন। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান। সব আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের সহায়। জয় বাংলা।”

মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনের মাধ্যমে সেই ঘোষণা পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। ঘোষণাটি চট্টগ্রামে প্রথমে গ্রহণ করেন সলিমপুর ওয়্যারলেস কেন্দ্রের কর্মীরা। তারা সেটি নন্দনকানন টিঅ্যান্ডটি অফিসে পাঠালে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছানো হয়। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে এ ঘোষণা বেতারে একবার শোনা যায়। পিলখানা ইপিআর (বিজিবি) ব্যারাক থেকেও স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে বার্তা আকারে পাঠানো হয়। এ ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরেও পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। জহুর আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।

রাত ১টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে প্রথমে শেরেবাংলানগরস্থ বাহিনীর দফতরে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে তাকে সেনানিবাসে নিয়ে আটক রাখা হয় আদমজী কলেজের একটি কক্ষে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জনযুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী। ৩০ লাখ প্রাণের আত্মাহুতি আর তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে অমূল্য স্বাধীনতা।

আমাদের সব আশা এখনো পূর্ণ হয়নি সত্যি। তবে অর্জন রয়েছে অনেক। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির অঙ্কে প্রাপ্তির যোগটাই বেশি। এ মাসেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তরণের যোগ্যতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ এখন এ অঞ্চলের শুধু নয়, বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর কাছেও উন্নয়নের এক রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় আজকের বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করবে তারা। সেই তারুণ্যের শক্তিতে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতা, বিনম্র শ্রদ্ধা ও বেদনায় স্মরণ করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর নারীদের। আজ ভোরে রাজধানীতে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা করা হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। সব ভবনে ও শহরের প্রধান সড়কগুলোতে উড়ছে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। সকালে ফুলে ফুলে ভরে উঠবে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে দলমত নির্বিশেষে হাজির হবে লাখো মানুষ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পক্ষে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর