শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

চিকিৎসাসেবা পাতালে হাসপাতালে

চিকিৎসা সেবার নামে বেহাল অবস্থা। অভিজাত হাসপাতালগুলো বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা। সাধারণ মানুষ জিম্মি। টাকা দিয়েও চিকিৎসা মেলে না। রাজধানী ঢাকাতেই হাসপাতালগুলোতে অভিযোগের পাহাড়। মাঝে মাঝে অভিযানও হয়। জরিমানা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক

চিকিৎসাসেবা পাতালে হাসপাতালে

অভিযানের খবর পেয়ে সম্প্রতি অপারেশন থিয়েটারে রোগী রেখেই পালিয়ে যান ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ভুয়া চিকিৎসকরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নিরাপদে নিজের প্রথম সন্তান প্রসবের জন্য কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন তরুণী ফারজানা। ভর্তি হন ঢাকার গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বহির্বিভাগ থেকেই জরুরি ভিত্তিতে সিজারিয়ান অপারেশন করতে বলা হয় তাকে। না হলে সন্তান ও মা উভয়কে নিয়েই শঙ্কার কথা জানায় হাসপাতাল। হতবিহ্বল স্বজনরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। চলতে থাকে অপারেশনের প্রস্তুতি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুই ঘণ্টা পরই স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করেন ওই তরুণী। ফারজানার স্বজনদের অভিযোগ, ‘শুধু টাকা নেওয়ার জন্য সন্তানসম্ভবা মায়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ না করেই সিজার অপারেশনের ঘোষণা দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা নেওয়াই এদের উদ্দেশ্য।’

সৌভাগ্যক্রমে ফারজানা কোনো তিক্ত পরিস্থিতিতে না পড়লেও ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা কম নয়। সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ভোলার আড়ত কর্মী চুন্নু ব্যাপারী। বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত চুন্নু থেঁতলানো পা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতালে) চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। কিন্তু পঙ্গু হাসপাতালের বারান্দায় আসতে না আসতেই অর্থলোভী দালালরা তাকে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে যান হাসপাতালের পাশেই থাকা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। চিকিৎসার জন্য এক লাখ ৬০ হাজার টাকার চুক্তি করে ক্রিসেন্ট কর্তৃপক্ষ। কোনো চিকিৎসা না করেই ফেলে রাখা হয় রাতভর। সকালে নেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। দুপুরে পরিস্থিতির অবনতি হলে ক্রিসেন্টের আয়া-বয়রা তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে অপারেশন শুরু করেন। পরে র‌্যাবের অভিযানে বিষয়টি ধরা পড়লে তাকে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গুরুতর আহত অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় দুই দিন পরে থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান চুন্নু। 

দিনে লাখ টাকা দিয়েও রাজধানীর অভিজাত একটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে ব্যবসায়ী খাজা মোহাম্মদ আসাদকেও। তার মেয়ে নাদিয়া আসাদ খাজার অভিযোগ, হাসপাতালটিতে থাকা অবস্থায় এক নার্স বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। এ অভিযোগ জানানো হলে চিকিৎসকরাও খারাপ আচরণ ও অবহেলা-অনাদর শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘এমনকি আমি মেয়ে হিসেবে অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে দেখতে পারিনি। একপর্যায়ে জানানো হয় তিনি মারা গেছেন।’ শুধু এই হাসপাতালে নেওয়ায় তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করে এরই মধ্যে আদালতে মামলা করেছেন বলে জানান নাদিয়া আসাদ খাজা। অবশ্য আন্তর্জাতিক চেইন হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত অভিজাত হাসপাতালটির বিরুদ্ধে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ নতুন নয়। ভুল চিকিৎসার অভিযোগে এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে আগে মামলা করেছিলেন সদ্য প্রয়াত রংপুরের সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝণ্টু। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, মামলা করলেও ভুক্তভোগীরা কখনই বিচার পান না। কারণ মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায় প্রভাবশালী মালিকদের কারণে। পুলিশও সেভাবে উৎসাহ দেখায় না। দিনে লাখ টাকা বিল আদায় করা এই হাসপাতালটিতেই ১৭ দিন ভর্তি ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে দুর্ব্যবহার, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের শিকার হতে হয়েছে তাকে। ডাক্তার ও নার্সদের ডেকেও সময়মতো আনতে পারেননি অধ্যাপক মোজাফফরের স্ত্রী জাতীয় সংসদের এমপি আমেনা আহমেদ। এমনকি তাকে রক্ত দিতে যাওয়া এক শুভানুধ্যায়ীকে হাসপাতাল থেকে রীতিমতো ভর্ত্সনা দিয়ে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই সময়ে। শুধু ভুল চিকিৎসা নয়, ঢাকার নামিদামি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ওপর মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ প্রয়োগ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্টের ব্যবহারের অভিযোগও আসে হরহামেশাই। গত সপ্তাহেই গুলশানের অভিজাত হাসপাতালে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ এবং রিএজেন্টের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রমাণ পায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয় ২০ লাখ টাকা। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে আরেক অভিজাত চেইন হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ভেজাল ওষুধের পাশাপাশি পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট। জরিমানা করা হয় মাত্র ৫ লাখ টাকা। অথচ এই হাসপাতালের ৫ লাখ টাকা জরিমানা কোনো বিষয়ই নয়। কারণ রোগীপ্রতি এখানে কমপক্ষে ১৫-২০ লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়। এমন রোগী কয়েকশ একই সময়ে চিকিৎসাধীন থাকেন হাসপাতালটিতে।

এত নামি হাসপাতাল এবং এত বিল আদায়ের পরও স্বল্প মূল্যের রিএজেন্ট কেন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ভেবে বিস্মিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তার মতে, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে পরীক্ষা করলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। তার মানে তখন হাসপাতালে রোগীকে বেশি দিন থাকতে হয় বা বেশিবার যেতে হয়। এতে ওই রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। কাজেই এটা ইচ্ছাকৃতও হতে পারে।’ ভুক্তভোগীরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা দেশের স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা কিছুতেই কাটছেই না। হাসপাতাল আছে, যন্ত্রপাতি ওষুধপথ্যের সরবরাহ যাচ্ছে নিয়মিত, আছে চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী; শুধু নেই কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা। রাজধানী থেকে শুরু করে নিভৃত পল্লী পর্যন্ত সর্বত্রই অভিন্ন অবস্থা। চিকিৎসকের বদলে নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়াদের দিয়ে রোগী দেখানো এবং ব্যবস্থাপত্র দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করা হচ্ছে হরহামেশাই। এতে মাঝে-মধ্যেই রোগীর পেটের ভিতর গজ-ব্যান্ডেজ, ছুরি-চাকু রেখে সেলাই করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। ওয়ার্ডবয়-আয়ার ‘ডাক্তার সাজা’র মধ্যেই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা সীমাবদ্ধ থাকছে না, আছে বহিরাগত দালালদেরও অন্তহীন উৎপাত। দালালরা নানা কায়দা-কৌশলে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এসব দেখভালের যেন কেউ  নেই। খোদ রাজধানীতেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বড় বড় হাসপাতাল আছে, শুধু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় সেবাবঞ্চিত থাকছেন রোগীরা। ডাক্তারের অবর্তমানে ওয়ার্ডবয় আর নার্স, আয়ারা হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। আছে দালালদের সীমাহীন উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে দালাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। পঙ্গু ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও গুনতে হয় টাকা। রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটফোর্ড হাসপাতালেও বাড়তি টাকা কামায় বহিরাগতরা। আবার ছুটির দিন আর রাতে হাসপাতালগুলোর চেহারা পাল্টে যায় আমূল। তৈরি হয় আরেক পরিস্থিতির।

সর্বশেষ খবর