শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আতঙ্ক তিন সাইবার অপরাধ

বাড়ছে পর্নোগ্রাফি, থেমে নেই হ্যাকাররা, অরক্ষিত অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা

ঝর্ণা মনি

দুচোখে স্বর্গের স্বপ্ন বোনা এক বছর আগে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে সংসারে পা রেখেছিলেন বেসরকারি সংস্থায় চাকরিজীবী কাসফিয়া তামান্না (ছদ্মনাম)। কিন্তু হাতের মেহেদির রং শুকানোর আগেই তাদের সংসারে নেমে আসে বিষাদের কালো ছায়া। শুরুটা হয় মধ্যরাতে এসএসএম আসা নিয়ে। প্রথমে তামান্নার মোবাইলে। পরে তামান্নার বরের মোবাইলে। অচেনা ফোন থেকে তামান্না সম্পর্কে নোংরা এসএমএস নিয়ে তামান্নার বর শুরুতে গা না করলেও কিছুদিন পর শুরু হয় নতুন উপদ্রব। তামান্না ও তার বরের মেসেঞ্জারে বিভিন্ন বাজে মেসেজ পাঠায় এসএমএসকারী। তামান্নার নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলে। একসময় তামান্নার মুখের ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের পর্নোগ্রাফি তৈরি করে তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠায়। স্থানীয় থানায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার হয়নি। মানসিকভাবে ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত তামান্না একসময় মহানগর সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ইউনিটে মামলা দায়ের করেন। ক্রাইম প্রতিরোধ ইউনিটের তদন্তে বেরিয়ে আসে, অপরাধী তামান্না ও তার বরের অত্যন্ত পরিচিত একজন। সে তাদের বিয়ে ও ভালোবাসা মানতে পারেনি। সে জন্য এসব করেছে।

প্রযুক্তিবিদদের মতে, সাইবার স্পেস বা সাইবার জগতে অনেক ধরনের অপরাধ হয়। এর মধ্যে হ্যাকিং শব্দটার সঙ্গে সবাই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পর্নোগ্রাফি সাইবার জগতের একটি বড় ধরনের অপরাধ। এ ছাড়া তথ্য চুরি, অনুমতি ছাড়া ছবি কিংবা তথ্য ব্যবহার করে হেনস্তা করার চেষ্টা, ই-মেইল বম্বিং অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ই-মেইল পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়াও এক ধরনের অপরাধ। আরেক ধরনের অপরাধ আছে- সাইবার বুলিং। ব্ল্যাকমেইল তো নিত্যদিনের ঘটনা। অন্যদিকে সাইবার অপরাধীদের কারণে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ফাউন্ডেশনের (ক্রাফ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অরক্ষিত ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার হচ্ছে বেশি। আর এর বেশির ভাগই শিকার হচ্ছেন নারীরা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন অর্থলগ্নি, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। অনলাইন ব্যবহারকারীর মধ্যে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত ২০ শতাংশ। আর তাদের অপরাধের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছেন ৭০ শতাংশ ব্যবহারকারী। ব্যক্তি পর্যায়ে সাইবার অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই নারী। ইন্টারনেটে পরিচয়ের মাধ্যমে প্রথমে বন্ধুত্ব, প্রেম আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি। পরে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে গোপনে অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। কখনো কখনো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউবে। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ক্রাফের গবেষক তানভীর জোহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাইবার ক্রাইম মূলত তিন ধরনের প্লাটফর্মে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঘাত, ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বিষয় সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এর মধ্যে ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপরই অধিক আঘাত হয়। আর বাংলাদেশে এ অপরাধের ঝুঁকিই বেশি। এই অপরাধের বেশির ভাগ শিকারই নারীরা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। বাকি ১০ শতাংশের বয়স ৪৫ থেকে ৬০ এর মধ্যে। এদিক থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সাইবার ঝুঁকিতে রয়েছে তরুণ সমাজ।

জানা গেছে, সাইবার অপরাধের বিষয়ে থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে প্রতি মাসে হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়ছে। অভিযোগের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেশির ভাগ অভিযোগেরই শিকার নারীরা। এসব অপরাধের বিচার হয় রাজধানীর একটিমাত্র ট্রাইব্যুনালে। একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ৩৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে সবাইকে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ইউনিটের এডিসি নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৫ সালের মে মাস থেকে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ইউনিট কাজ করছে। ঢাকা মহানগরীর ২ কোটি মানুষকে আমরা নিরাপত্তা দিচ্ছি। তবে এটি সত্য, যারা সাইবার অপরাধী, তারা নানা কৌশলে প্রতিনিয়ত অপরাধ করছে। আমরাও বসে নেই। গত তিন বছরে প্রায় ৩০০ মামলা নিষ্পত্তি করেছি। এখনো প্রতি মাসে ১০টির মতো মামলা আমরা করি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা তাত্ক্ষণিক উদ্যোগ নিই। প্রথমে মীমাংসার মাধ্যমে ন্যায়বিচারের চেষ্টা করি। সর্বশেষ মামলা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্যক্তি-গোষ্ঠী ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সাইবার দুর্বৃত্তায়ন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে লক্ষ্য করে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে সাইবার দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেউ ছুরি দিয়ে সবজি কাটে, আর খুন করে। এটি নির্ভর করে ব্যক্তির কার্যক্রমের ওপর। ফেসবুকে কেউ হয়রানির শিকার হলে তাত্ক্ষণিকভাবে রিপোর্ট করা হলে ওই আইডি বন্ধ করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তবে এসব সমাধান নয়। কিন্তু বড় ধরনের অপরাধের আগে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তানভীর জোহা বলেন, অনলাইনে যে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং খাতে আমরা প্রচুর ঝুঁকিতে আছি। আমরা কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনেক লেনদেন করি। বিপজ্জনক এবং ভয়ঙ্কর সেক্টর এটি। যে ধরনের ‘ফায়ারওয়াল’ বা নিরাপত্তা বেষ্টনী এখন আছে, তা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, আরেকটি সমস্যা কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে। আমরা কিন্তু প্রায়ই অনলাইনে টিন নম্বর বা কাস্টমার ক্রিডেনশিয়ালগুলো ই-মেইলের মাধ্যমে ব্যাংকে দিয়ে থাকি। আর হ্যাকাররা যখন কোনো ব্যাংকে হামলা করে, তার আগে তারা ওই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে কোর ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়, যাতে কোর ব্যাংকিংয়ে প্রবেশ করতে পারে। আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোতে এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে এতটা দক্ষ নন। ফলে কিছু না বুঝেই তারা যখন হ্যাকারের ই-মেইল  খোলেন, তখন ম্যালওয়ারগুলো নেটওয়ার্কের মধ্যে ঢুকে গিয়েই তার কার্যক্রম শুরু করে। এসব বিষয়ে ক্রাফ ইতিমধ্যে কিছু ট্রেনিংয়ের আয়োজন করতে যাচ্ছে। কীভাবে এই ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বের করা যায়, কীভাবে অ্যাডভান্স থ্রেট ম্যানেজমেন্ট করতে পারব সে বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর